বিষয় হিসেবে বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে ইতিহাসচর্চা পশ্চিমী দেশগুলিতে সাংস্কৃতিকবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের বিদ্যাচর্চা ও সাহিত্যমহলে এই চর্চা অবশ্যই বিস্ময়ের জায়গা তৈরি করে। বন্ধুত্বের মধ্যে যুক্ত থাকে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামো এবং সেই পরিসীমার মধ্যে শুরু হয়ে যায় আমাদের নিত্যনতুন চলাচল। সেই সামাজিক উত্তরাধিকার আমরাও বহন করে চলি। ফলে, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ ও আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে আপামর সমাজের ক্ষুদ্র, টুকরো আখ্যানের যে ধারণা তৈরি হয় তা আসলে একটা সংস্কৃতির সমগ্রতাকেই নির্দেশ করে। মলয় রক্ষিতের "এম টি গলির আশেপাশে" (কারিগর) পড়তে বসে এই কথাগুলি খুব স্পষ্ট করে অনুভব করা যায়। এই গ্রন্থে ইতিহাসকে ধারণ করে থাকে বিশেষ একটি সময়। সেই সময়ের অবদমিত সংস্কৃতি ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে অনেক সুযোগ রেখে যায় একটা আঞ্চলিক ইতিহাসের সম্পূর্ণতা তৈরি করতে।
বন্ধুত্বের সঙ্গে চলে আসে ক্লাসরুম, শিক্ষক, কমার্সের বিভাগ বখাটে ছেলেদের চরিত্র, 'ভালো ছেলেদের' এলিট হয়ে ওঠার একটি আন্তর্বিভাজন রেখা। প্রাতিষ্ঠানিক ভালো খারাপ-এর সীমারেখায় 'ভাষা' ও 'ব্যবহার' কীভাবে ইতিহাসের বহুমাত্রিকতা তৈরি করে মলয় রক্ষিত তার সমগ্র আখ্যানের এগারোটি অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন সেই যাপনচিত্র।
'এম টি গলি' এখানে একটি রূপক ও বাস্তবের উদ্দীপক, জীবনের এক নিজস্ব সিন্দুকে আবদ্ধ সংলাপ। কী আছে ওই বর্ধমানের এম টি গলিতে? এম টি গলি হল নাগরিক সমাজের বৈষম্যমূলক মানসিকতার line of control। সামাজিক অবস্থানের ইতিহাসও নির্ভর করে এই ধরনের 'এম টি গলি' 'হাড়কাটা গলি' 'সোনাগাছি' 'কালীঘাট ব্রিজ' ইত্যাদি স্থানাঙ্ককে সামনে রেখে, যার নিঃশ্বাস ও অনুরণন তৈরি করে সময়ে ভাষ্য। সমগ্র এই আখ্যানে বিশেষ একটি সময়ের চেতনা ও মানসিকতা তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে পথ হাঁটে। কিন্তু মান্য ভাষার মধ্যে দিয়ে 'চিহ্নিত' রুচির পাঠ ও মনন এতটাই বৈপরীত্যময় যে, পাঠক কখনই সঠিক পথে না পৌঁছে একটি রাস্তার অলিগলিতে হেঁটে রাজপথ অতিক্রম করার আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে। এই লেখায় যেন সেই অনুভূতির ইতিহাসটিও স্পষ্ট হয়েছে বিচিত্র আনকাট স্ল্যাং এবং যৌনঅনুষঙ্গের প্রয়োগে, যা হয়তো অনভ্যস্ত পাঠককে আঘাতও করতে পারে।
'এম টি গলি' 'মহাজন টুলি গলি' এগুলো সমাজেই আছে - কিন্তু তার সম্বন্ধে আমাদের কোনো জ্ঞান থাকে না - এমনকি উচ্চারণ করি না আমাদের চিহ্নিত 'ভদ্র' পরিসরে। এই গলির ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া আসলে একটা সমাজ সম্পর্কে আত্ম-দর্শন - এটাও তো একটা আবিষ্কার। যদি অন্ধকারই হয় তাহলে ভদ্রমহোদয়গণ যুগযুগ ধরে আলো দিতে পারলেন না কেন? - এটি একটি সময়ের নিম্নবর্গীয় স্তরের প্রশ্ন - এর উত্তর ইতিহাসকে দিতে হয়। মলয় রক্ষিতের চিন্তায় - এখানে জাতধর্ম ভেদকারী সমাজের এবং বিশুদ্ধতার ধুয়ো ধরা বাম রাজনীতির রক্তচক্ষু, যা নব্বইয়ের কৈশোর থেকে যৌবনকে সাংস্কৃতিক পরিসরে নিয়ন্ত্রণ করেছে, এই আখ্যানের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা যৌনবিদ্রোহ আসলে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে কাউন্টার।
সমগ্র আখ্যান জুড়ে যৌনতা ও চিন্তার আগল খুলতে খুলতে আবিষ্কার হয়েছে দেহ এবং দেহের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক নিষিদ্ধ আখ্যান। দেহ ও যৌনতার আবিষ্কার আসলে সমাজতাত্ত্বিক ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে গিয়ে মানুষের মননের মুক্তির আবেগ। বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকা 'মেডিকেল সেক্স গাইড বই' থেকে 'জগদিঘির পাড়', সেখান থেকে 'মুক্তকাকার' জীবন ও যৌনতার মধ্যে প্রবেশ, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বয়ঃসন্ধির বিবর্তন। সেই বিবর্তন রেখার মধ্যে তাহলে কিন্তু শুধু নীতিমূলক গল্প কিংবা খেলার মাঠই রইল না – একাকার হয়ে গেল 'শ্যালোঘর'-এর যৌন শিক্ষার পাঠদান ও নিজেকে চিহ্নিত করে তোলা একটি রোমাঞ্চের সঙ্গে মুক্তচিন্তার।
'সোনা ডান্সার' থেকে 'হেমাজেঠি', পানু গল্পের মধ্যে ঢুকে পরা একটি সত্য প্রেমের আখ্যান - সেইসব কথা আসলে যারা ক্লাস ইলেভেনের বয়সটা থেকে বহুমুখী সমাজের চালচিত্র ও বাঁধা শরীরের হতাশার স্থলে স্বনির্মিত মুক্তাঞ্চল। 'কাল্টিবুড়ি' কিংবা 'ভুবন দাদু', 'মেহবুব চাচা' ও 'বিন্দি দিদি'র প্রেমের কাহিনি - সবকিছুই সমাজের এমন এক গোপন উত্তেজক স্তর যার রহস্য ও খোঁজ সবাই কোনো না কোনোভাবে গণ্ডিবদ্ধ জীবনে করে থাকেন।
বন্দি সেই মানুষটা তো শিকল ছিঁড়তে চায় - যে শেকল ছেঁড়ার খেলাতেই 'কালীমাতা ভিডিও হলে' রফিকের সঙ্গে 'মসরৎ ভাই আর আইয়ুব চাচা'র দেখা হয়ে যায়।
সমগ্র লেখার সিনেমাটিক ভিউ আর চরিত্রের অন্তর্গঠন, চলনের চিত্রবিন্যাস ও মনস্তত্ত্ব যেন একটি লুকিয়ে রাখা অন্ধকার আর আলোর স্থিরচিত্র। সমকালীন বাংলা আখ্যান এই রচনার মধ্য দিয়ে খানিক সাবালকত্ব লাভ করল।
গ্রন্থ : এম টি গলির আশেপাশে
লেখক: মলয় রক্ষিত
প্রকাশক : কারিগর
মূল্য : ২৫০/-
Powered by Froala Editor