প্রায় জনা বারো-তেরো চরিত্র হাঁটছেন। একটা শপিং মল বা কমপ্লেক্সের বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তায়। সে রাস্তার চারপাশে আলো, ’পরমোৎসব রাতি’, মোচ্ছব চলছে কিছুর। অকাতরে বাজি ফাটছে, প্রায় নি:শব্দ হেঁটে যাওয়ার আবহে সেই দুমদাড়াক্কা আওয়াজ। মাঝে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ বেজে উঠলো কিছুক্ষণ। হাঁটছেন জনা বারো-তেরো অস্তিত্ব। তাঁদের কারুর হাতে একগোছা লাল বেলুন, কারুর হাতে ফুলের তোড়া, কেউ উপঢৌকন ধরে... এগোচ্ছেন... নিঃশব্দ... একঘেয়ে...। নেতৃত্বে একজন দুধসাদা পাঞ্জাবি-পাজামা-জহর কোটে সজ্জিত থলথলে লোক, দৃশ্যতই যিনি নেতা। নানা বয়েসের তরুণ, যুবতী, টিন এজার, মধ্যবয়স্কা, মিডল এজেড ইন্টেলেকচুয়াল তাঁকে অনুসরণ করছেন। ক্যামেরা তাঁদের তাক করে ‘পিছনের দিকে এগিয়ে’ চলেছে। এই চলার পথেই কেউ কেউ হাতের উপঢৌকন নামিয়ে রাখেন আশপাশের বাড়ির বন্ধ দোরের সামনে, কেউ ফুলের তোড়া ছোঁড়েন এদিকওদিক, বেলুন উড়িয়ে দেন কেউ। নেতা বারদুয়েক প্রচারকালীন শোভাযাত্রার ঢঙে আশপাশের ব্যালকনির দিকে চোখ তোলেন, যদিও রাতের নৈঃশব্দে সব কেমন ফাঁকা, কেবল বাজির শব্দ ইতিউতি। মোচ্ছব নির্ঘাৎ, কোনো পুজো আছে বোধহয়। প্রায় মিনিট দশেক এভাবে হাঁটার পর তাঁরা এসে দাঁড়ালেন আধাজীর্ণ এক বাড়ির সামনে। দরজা খোলা হল। সিঁড়ি বেয়ে নামলেন তাঁরা। এখন সেই নেতৃত্বে থাকা সাদা পাঞ্জাবির হাতে জ্বলন্ত এক হাত উচ্চতার মোমবাতি। তাকে রাখা হল মহার্ঘ্য ওয়াইন-ভদকা-ফল আর খাবারে সুসজ্জিত বড়ো টেবিলের মাঝখানে। মোমবাতিটা প্রতিষ্ঠা করা হল যেন, একটা রিজিড রেজিমেন্টেশনের দ্যোতনা নিয়ে। তাঁরা বসলেন টেবিল ঘিরে। আসুন, আমরাও খানিক নড়েচড়ে বসি।
একটা বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে একটা সোজা রাস্তা। যে রাস্তাই নাকি একমাত্র রাস্তা। সেখান থেকে ‘অলি গলি চলি রাম’ হয়ে একটা আদ্যিকালের কী এক ভবন, মরচে ধরা তালা খুলে আবার একটা সিঁড়ি। স্পষ্টতই স্পেসের ধারণা আপনার গুলিয়ে যাবে। এরপর জানা গেল ওই মোচ্ছব সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠারও হতে পারে, কারণ নেতামশাই (সুরজিৎ সেন) ঘোষণা করলেন আজ একটি বিশেষ দিন। দীর্ঘ সংগ্রামের শেষে প্রায় রক্তপাতশূন্য এক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণী বিষয়টাই নিকেশ করা গেছে। প্রশ্ন স্বাভাবিক, এটা সত্যি? নাকি বাইরে মানুষ নিজের খেয়ালে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রীতির উৎসবে বাজি ফাটাচ্ছে, আর প্যারালাল এই বিশ্বে, কোনো এক আজব স্থান-কাল গুলিয়ে দেওয়া কোটরে বসে এঁরা ঘোষণা করলেন, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে! মুখ ফেরানোর এই খেলা গোটা ছবি জুড়ে চলতে থাকে। জয়রাজ ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ‘ঘ্যাচাং ফু’ (২০১৭) শুরুতেই কেবল স্পেস নয়, টাইমকেও খানিক গুলিয়ে দেবে এবার। ওই বৈঠকে, আরেক সারাক্ষণ বিচিত্র এক চশমা পরিহিত চরিত্র (কিউ) বিপ্লবের দিনগুলিতে হারানো কমরেডদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে চাইলেন। ক্যামেরা নানান সদস্য ও সদস্যার দামি হাতঘড়ি, ট্যাঁকঘড়ি, বিভিন্ন কোম্পানির ভিনটেজ থেকে হাল ফ্যাশনের দেয়াল ঘড়ির উপর থামতে থামতে গেল বেশ খানিকক্ষণ, প্রতিটার সময় আলাদা। একজন (গৌতম সরকার) নিদান দিলেন, এক মিনিট হয়ে গেছে। আর কিউ অভিনীত চরিত্র জানালেন, হয়নি। মতদ্বৈধের শুরু এবার, শুরু আক্রমণেরও। ‘আপনি যদি সময়কেই প্রেডিক্ট করতে না পারেন, তাহলে আপনি কীসের ল্যাওড়া কমিউনিস্ট?’
ঘড়ি এঁদের সবার খারাপ। মেজাজও। বাদানুবাদের উপক্রম হ’তে নেতা বললেন, আজ শুভদিন। শ্যাম্পেন খোলা হোক। এক টুপি পরা কমিউনিস্ট (সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়) আবার ভদকার পক্ষপাতী। যা হোক, বৈঠকের টেবিলেও মোচ্ছব শুরু হল, আর সঙ্গে আলোচনা। কর্মপ্রণালী ও রাজনৈতিক পথ বিষয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক। এক চরিত্র আরেকজনের উচ্চারণের ভুল ধরেন, তো আরেক মধ্যবয়েসি মহিলা (সুদীপ্তা) তথ্যগত ত্রুটি দেখান। কবে লেনিন কাকে কোন্ চিঠির কত নম্বর লাইনে কী লিখে আবার কেটেছিলেন, এমন বায়বীয় তর্কাতর্কির বাতাবরণে দর্শক অচিরেই বুঝবেন এই জাতীয় কেঠো তাত্ত্বিকতা কী ভীষণ জনবিচ্ছিন্ন। যে জনবিচ্ছিন্নতা, মত ও বিশ্বাসের সঙ্গে যাপনের তীব্র দূরত্ব বারবার প্রকট এই ছবির চরিত্রদের মধ্য। পরিচালক ও তাঁর সহযোগীরা এককথায় বলতে গেলে, সেই দূরত্বের অসহায়তাই প্রতিটি শটে হাজির করেন। টুপি পরা সেই চরিত্রের এক আপাত পোষমানা স্ত্রী আছেন (কমলিকা), যাঁর প্রতি লোলুপ নজর আরেক কমরেডের। টুপিবাবু এবং সেই কমিউনিস্টের মধ্যে অকাতর আলোচনাও চলে নারীশরীরের খাঁজভাঁজ নিয়ে। ‘মেয়েদের বুকে আর পাছায় একটু মাংস না থাকলে ভালো লাগে না। বিশেষ করে পাছায়।’ আর সেই সূত্রেই মধ্যবয়স্কা কমরেডের কাছে গালি খান লোলুপ নচ্ছারটি। নারী যে আসলে একটা পণ্য বই কিছুই নন পুরুষ কমরেডের কাছে, এই সত্যি যিনি সামনে আনছেন সেই সুদীপা অভিনীত চরিত্র স্বমেহনে অবসেসড। সারাক্ষণ তাঁর সেই অভ্যেস জারি থাকে, মুখে চলে লিঙ্গসাম্যের বাণী। অথচ এই লিঙ্গসাম্য কীভাবে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ একগামিতার আইডিয়াসর্বস্ব নারী-পুরুষের সম্পর্কবিধি মেনে আসবে, সে বিষয়ে তাঁর ভাবনা ‘সেকেলে’। সেটা নিয়ে যৌনস্বাধীনতার প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলেন আরেক মহিলা, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন দামিনী বেণী বসু। সুদীপ্তা অভিনীত চরিত্রটির টিন এজার মেয়ে, যিনি এই ছবিতে এক নীরব দর্শকের ভূমিকায়, যাঁর নীরবতা প্রত্যেকের কথা ও কাজের পার্থক্যকে উপলক্ষ ক’রে ভাঙে, তিনি হদিশ পান এক আদ্যিকালের তোরঙ্গর, যার ভেতর গা ঘেঁষাঘেষি ক’রে সেঁধিয়ে থাকে মার্কসিস্ট লিটারেচার আর হলুদ পানু বই। তাঁর শরীর সহমর্মিতা চায়, রহস্যের প্রত্যাশায় লিপ্ত হয় সমপ্রেমে। এগুলোর কোনো ইস্যুতেই এই ছবি বেশিক্ষণ আদিখ্যেতা দেখায় না। বেণী অভিনীত চরিত্র দুই যুবক ও এক স্পেনীয় অতিথি যুবতীর সঙ্গে গণসঙ্গমে মাতেন ছাদের উন্মুক্ততায়, আর টুপিবাবুর স্ত্রী গৌতম অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে যৌন আদানপ্রদান চালান রান্নাঘরে। ‘দ্য ওয়ে ইউ লাইক মাই অ্যাস, সামওয়ান এলস প্রেফরস মাই হেয়ারি কান্ট’, কমলিকা অভিনীত চরিত্রটি সাম্যবাদী ডিস্ট্রিবিউশন প্রসঙ্গে জানান। এই উদ্দাম শরীরখেলা, যার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্ন, যা থেকে সকলকে বিচ্যুত রাখতে চাওয়া হয় রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে, আর যা আদৌ রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা, তা নিয়ে তর্ক চলতেই থাকে, সেটার উত্তেজক বাতাবরণে চশমা পরা সেই এলিট কমিউনিস্ট স্বগতোক্তি করেন, সীমাবদ্ধ চিন্তাকে আমাদের জয় করতেই হবে।
আরও পড়ুন
স্বপ্ন আর বাস্তবকে দেখতে নতুন দৃষ্টি নিয়ে হাজির নতুন শর্ট ফিল্ম ‘চোখ’
কিউ অভিনীত এই চরিত্র দলিত নেতার উচ্চারণের ভুল ধরছিলেন ক্ষণে ক্ষণে। আর সেই ছোকরা নেতাটি সপাট জানিয়ে দেন, আসলে এলিটগণ জানেন এসব ছেঁদো ভুল ধরাতেই তাঁদের মৌরসীপাট্টা গেঁড়ে আছে। স্টাডি ক্লাসের বকবকানিতে তিনি উৎসাহী নন, তাঁর গরম রক্ত কাজে বিশ্বাসী। হঠাৎ আবির্ভূত স্পেনীয় যুবতীর যৌনাঙ্গ লেহনের ফাঁকে তিনি বন্দুক বের করে পাঞ্জাবি পরা নেতাকে গুলি করেন। সেই নেতা ‘মরে যাবো?’ জিগ্যেস করে সিরিয়ালের ঢঙে তিনবার উল্টে যান। অদৃশ্য দৈববাণীর মতো পরিচালকের কন্ঠস্বর শোনা যায়, ‘হ্যাঁ মরুন। আরে মরে যান!’ এই পুতুলখেলার সূত্রধর কে তবে? জনতা? এই আকাশবাণী তাঁদের? কে জানে ! শুরুর সেই শোভাযাত্রায় বারবার ক্যামেরাম্যানের ছায়া পড়তে থাকে নেতার গায়ে। পরিচালকের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ক্যামেরা প্রকৌশলী জানান, ছায়া পড়ুক, অসুবিধে নেই। মিডিয়ার ছায়া? গণতন্ত্রের এক স্তম্ভের ছায়া? যা পড়ুক, না পড়ুক আসলে কিছুতেই কিছু অসুবিধে নেই? যে ছায়া আসলে প্রগাঢ় হয় না কখনোই, এই আসে এই চলে যায়। আর আবহে কখনও বাজতে থাকে ইন্টারন্যাশনাল, কখনও ফাটতে থাকে অকাল দিওয়ালির বাজি!
আরও পড়ুন
‘হিউম্যান কম্পিউটার’, বই লিখেছেন সমকামী সম্পর্ক নিয়েও; শকুন্তলা দেবীর জীবন এবার পর্দায়
সাম্যবাদী বউমা কমরেড, যাঁকে সুইটহার্ট বা হানি বললে সাড়া মেলে না, কমরেড বলে একবার হাঁক দিলেই বিলম্ব না করে হাজির হন, যে চরিত্রে অভিনয় করেন কমলিকা, ওই নারীলোলুপ তাত্ত্বিকের সঙ্গে তাঁর শরীরী খেলার পর যখন সে কথা জানতে পারেন তাঁর স্বামী টুপিবাবু (সুদীপ্ত অভিনীত চরিত্র), তিনি আশপাশের পরিবেশ, প্রায়োরিটি, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ভুলে চিল চিৎকারে হাহুতাশ করতে থাকেন। না, বউ অন্য কারুর সঙ্গে শরীর দেয়া নেয়া করেছেন, এটা তাঁর কান্নার কারণ না, তিনি যে আনাল সেক্স চেয়েও পাননি, তা অন্য কারুর ভাগে যাওয়ায় তিনি বেমালুম বিমর্ষ! কিন্তু সাম্যবাদ যেহেতু প্রতিষ্ঠিত, তাই স্ত্রী স্বামীকে অধিকার দেন, সাম্যবাদী ডিস্ট্রিবিউশনে একজনকে যখন দেওয়া হয়েছে, তখন ‘আমি তোমাকে আমার পোঁদ মারতে দেবো।’ কমলিকা রান্নাঘরে শরীরী উদ্দামতার খানিক আগে ফ্রিজ থেকে খাবার হিসেবে বের করেন বেশ কয়েকটি কাটা হাত, মাথা বা পায়ের টুকরো। মানুষের। রক্তমাখা। ঘিনঘিনে। ডিসটোপিয়ান মেটাফরের বেশ চর্চিত ও কিঞ্চিৎ স্থূল এই প্রয়োগ। পরিচালক বেশ কয়েক জায়গায় এমন কিছু স্থূল রূপক ব্যবহার করেন, ইচ্ছাকৃতই হয়তো। বাংলা ছবির ইতিহাসে অপপৃথিবীর রূপায়ণ খুব চোখে পড়ে কি? এমন এক ডার্কনেস যা দেখে আপনার বিবমিষাও হ’তে পারে? এমন কিছু পাপপ্রশ্ন, যার উত্তর সহজে মিলবে না, ফলে প্রশ্নগুলো কাঁটার মতো বিঁধবে, আর আপনি সেসব প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে আসলে প্রত্যক্ষ করবেন একটি বহতা সময়ের অসহায়তাকেই।
পরিচালককে আমি জিগ্যেস করেছিলাম, যেসব মূল্যবোধকে সঙ্গী করে আমরা, সাধারণেরা বেড়ে উঠি, উনি কি সেসবের কোনোটিতেই গভীরে আর ভরসা রাখেন না? জয়রাজ জানিয়েছিলেন, যাপনের এক অকৃত্রিম ভালনারেবলিটিকেই তিনি চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন, আর এই প্রয়াসে চেয়েচিন্তে জোগাড় করা লাখ তিরিশ টাকার বাজেটে অভিনেতারা, প্রকৌশলীরা প্রায় সবাই কাজ করেছেন বিনা পারিশ্রমিকে। হেসেছেন, কেঁদেছেন, চুমু খেয়েছেন, নগ্ন হয়েছেন, আজ্ঞে, বিনা পারিশ্রমিকে। এই ছবিতে পরিচালক শেষ কথা নন, তাই সচেতনভাবে টাইটেল কার্ড গল্প-চিত্রনাট্য-সংলাপ-পরিচালনায় জয়রাজের নাম দেখানোতেই শেষ হয় না, তারপর একে একে আসে এডিটর, ডিওপি প্রমুখের নাম। জয়রাজ এই ছবির আরো অনেকের মতো একজন, তাঁর নাম সচেতনভাবেই আলাদা করে নয়, ভেসে থাকে টাইটেল ক্রেডিটের প্রবাহে মাঝামাঝিতে। এই ছবি জনসমক্ষে প্রথাগত রিলিজ করেনি কখনও। সেন্সর বোর্ডে পাঠানো হয়নি, কারণ স্বভাবতই নগ্নতার বিষয়ে সেন্সরকাকুরা যে যে দাবি জানাবেন, তা পরিচালক মানতে চাইতেন না।
আরও পড়ুন
সুশান্তের শেষ সিনেমা ‘দিল বেচারা’-র মুক্তিও অনলাইনে! বড়ো পর্দার দাবিতে সরব অনুরাগীরা
অসহায়তা আর রাজনৈতিকতা এই ছবির প্রধান দুই স্তম্ভ বলেই এর শেষ আধ ঘণ্টা এক তীব্র অজাচারকে চিত্রায়িত করে। অপ্রত্যাশিত লম্বা এই দৃশ্যে অধুনা প্রখ্যাত অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য আর শ্রুতি ঘোষ, ভাইবোনের চরিত্রে, বিডিএসএম ও সঙ্গমে মেতে থাকেন। গোটা ছবিতে তাঁরা সেভাবে কোনো ভূমিকা নেননি, মিটিংয়ে উপস্থিতি ছাড়া। মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে সপ্রেম তাকিয়েছেন, তাঁদের মনে পড়েছে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। তাত্ত্বিকেরা যৌনস্বাধীনতা ও মনোগ্যামি প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের ‘দ্য অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যাণ্ড দ্য স্টেট’ নিয়ে আলোচনা করেন, এঁরা পরস্পরের দিকে তাকান। দর্শক তখনও জানেন না তাঁদের মধ্যে রয়েছে রক্তের সম্পর্ক, আদি মানব-মানবীর মতো। টেবিল বৈঠক তখন মদে চুর হয়ে শেষ, কোনো প্রশ্নেরই মীমাংসা তেমন হয়নি, কোনো কর্মপ্রণালীই ঠিক করা যায়নি নেশা আর শোওয়ার ঘোরে। ফাঁকা টেবিলে জ্বলন্ত, উদ্ধত পুরুষাঙ্গের মতো সেই মোমবাতির সামনে সহোদর-সহোদরার আমিষ আদর। কয়েকটি ফ্রেমে জয়রাজ প্রচলিত ফ্রেম ডিজাইনকে ভাঙতে চান, সে আলোচনায় বিস্তারিত যাচ্ছি না। একসময় আঘাতের আনন্দে মত্ত অনির্বাণের চরিত্র তাঁর দিদির নগ্ন বুকে মোম ঢালতে থাকেন। যেন উত্থিত লিঙ্গ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বীর্য গড়িয়ে পড়ে নারীশরীরে। সেই মোমবাতি স্পষ্টতই খ্রিষ্টিয় অনুসঙ্গ স্মরণ করায়, আর তার সামনে চলতে থাকে অজাচারের মতো এক তীব্র ‘পাপ’। ভাইবোনের এই যৌনতা, দুই নরনারীর এই নগ্নতার দৃশ্য ছবির বাকি সময়ে চলতে থাকা বিশ্বাস ও যাপনের দূরত্ব মুছে দেয়, এই সময়টুকুই সবচেয়ে সৎ মনে হয়। ছবির শেষে সম্পূর্ণ নগ্ন অনির্বাণ অভিনীত চরিত্রটি শুয়ে থাকেন টেবিলের উপর। মুখে একচিলতে হাসি, হাতে হাতকড়া। তাঁর কণ্ঠনালি ধারালো কাঁচের টুকরোয় ছিন্ন। সেটি করেছেন তাঁর যৌনসঙ্গিনী তাঁর দিদি। কোনো স্মৃতি নয়, কোনো প্রত্যাশা নয়, কোনো মুখোশ নয়, শেষ দৃশ্যে থাকে একলা সেই মেয়েটির হেঁটে যাওয়া। কেন মারলেন তাঁর ভাইকে? আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রশ্নে কোনো আপসে? নাকি গভীরতর কোনো সংকটে আসলে মুণ্ডহীন ‘ঘ্যাচাং ফু’ পুরো সময়টাই?
ছবিটার গল্প তবে কী? নেই। সেভাবে কোনো গল্পই নেই। থাকার কথাও না। নিটোল গল্পের খোঁজ তেমনভাবে আমাদের বেঁচে থাকাতেও আছে কি? টুকরো মুহূর্ত জুড়ে চলা ছাড়া, স্বপ্নভঙ্গের প্লুতস্বর একটানা শুনে যাওয়া ছাড়া, অন্ধকার বাঁচায় টেনে হিঁচড়ে ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না’ ছাড়া ?
পুরো ছবিটিই ডিজিট্যাল ঝকঝকে পরিচ্ছন্নতা এড়িয়ে তৈরি। ছবির দৃশ্যগুলিতে অসংখ্য আঁচড় পাবেন আপনি। পাবেন আনইভেন গ্রেন। অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ এই কাজটি জয়রাজ ও তাঁর প্রকৌশলী বন্ধুরা করেছেন, যেখানে ফ্রেম বাই ফ্রেম ধরে কালার কারেকশন দরকার পড়ে। ডিজিটাল চাকচিক্য রাখতে এই পরিশ্রম করতে হত না। কিন্তু সেই মাপা তকতকে পরিচ্ছন্নতায় অপপৃথিবীর চেহারাও খোলতাই হত না। এই পরিশ্রম পরিচালকের একটি রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট, তিনি চাকচিক্যের দামী হাতছানি এড়াতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। সাম্প্রতিক অতীতে এই ধরণের নিরীক্ষার নজির চৈতন্য তামহানের মারাঠি ছবি ‘কোর্ট’ (২০১৪) আর আনন্দ গান্ধীর ‘তুম্বর’ (২০১৮)। যদিও তাঁদের প্রোডাকশনের বাজেট অনেক বেশী, আর কারিগরি দক্ষতা বাজেটের বৈষম্যকে পুরোপুরি কব্জা করতে পারেও না সবসময়। ফলে এদের তুলনার কথা বলছিও না। কিন্তু, জয়রাজ, এমনকি ইভেন বা জোড় সংখ্যার গ্রেনকেও অগণতান্ত্রিক মনে করেন, কারণ গণতন্ত্রে বিচার হয় আনইভেন বা বিজোড় সংখ্যার মাধ্যমে। আমরা, যারা ছবি তৈরির কৌশলের সঙ্গে তেমন পরিচিত নই, তারাও একটু নজর ক’রে দেখলেই বিষয়টি বুঝবো। জোড় সংখ্যার গ্রেন ডিজিটাল অবশ্যই নয়, কিন্তু ডিজিটালের একটু হলেও কাছের হয়ে যেতো, তাই এই বিজোড় পদ্ধতি, এই শ্রমস্বীকার। জয়রাজ প্রশ্ন করেছেন, আঙ্গিক ও বিষয়ের প্রচলনকে প্রশ্ন। ফর্ম ও কনটেন্টকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছেন, এমনটা সচেতনভাবেই বলব না, তা কিছুটা অতিকথন মনে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নগুলো ওই মোমবাতির মতোই অস্বস্তিকর উত্থিত থাকে।
ছবিটি আগামীকাল অনলাইন মাধ্যমে দেখিয়ে পরিচালক জয়রাজ ভট্টাচার্য ও তাঁর বন্ধুরা কিছু টাকা পেলে তা কোভিড ও আমফানের রিলিফে ব্যবহার করবেন। কম্যুনিটি কিচেনের কাজ চালাচ্ছেন তাঁরা, তারই কাজে দেবে সেই অর্থ। পারলে দেখুন। এক অপপৃথিবীর কাটা মুণ্ডুর নাচ আমাদের পৃথিবীর কিছু কাজেও লাগুক নাহয়।
Powered by Froala Editor