একটি ছবি, একটি সত্যি আত্মহত্যা এবং উনিশে এপ্রিল

কাদম্বরী দেবীর প্রাণহীন দেহটি নাকি পড়ে ছিল ঠাকুরবাড়ির অন্দরে। প্রিয় পুরুষকে না পাওয়ার শোকে নিথর, রবির বৌঠান। ঠিক যেভাবে, ফিল্মের শেষে অদিতি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ঘরের। হাজার ধাক্কায়…

নব্বইয়ের দশকে মুক্তি পেয়েছিল ১৯শে এপ্রিল। ফিলিপসের টিভি। 'বোকা-বাক্স'। ঝিরিঝিরি দূরদর্শন। সেখানে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবির সম্প্রচার। পরিচালক, তরুণ ঋতুপর্ণ ঘোষ। সদ্য ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট থেকে সাবালক হয়ে,কালার টেলিভিশন ঘিরে আমাদের গোল হয়ে বসা। জামবাটি ভর্তি মুড়ি চানাচুর সমেত, নতুন 'আর্ট ফিল্ম' দেখা। সে যাহোক। সিনেমাটা ছোটখাটো হুল্লোড় ফেলে দিয়েছিল বটে..

জল গড়িয়েছে বহুদূর। পরিবার ও পিতৃতন্ত্র নিয়ে হাজার হাজার গবেষণাপত্র, এখনও কলেজ স্ট্রিট ছাপাখানায়। বই বেরোবে-বেরোবে। বিভিন্ন সেমিনারে-পথসভায়, বক্তব্যে স্লোগানে নারীর অধিকার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্মান, নিয়ে তত্ত্ব-তথ্য-তর্কবিতর্ক। ছবিটা সেখানে, নিঃসন্দেহে মাইলস্টোন সন্দেহ নেই। তবে সেকথা থাক…

বলছি 'পুরুষের' কথা। হ্যাঁ, কাদম্বরীও নাকি চেয়েছিলেন ঠাকুরপোকে। তাঁর একমাত্র 'পুরুষ' কে। এই নিয়েই খানিক অগোছালো আড্ডা জুড়ে দেওয়া যাক…

১৯শে এপ্রিলের কেন্দ্রবিন্দু যদি মা-ও মেয়ের সম্পর্কই হয়ে থাকে, তবে সেখানে অদৃশ্য অথচ দৃশ্যমান পুরুষকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যেমন , সরোজিনী ও অদিতির মধ্যে যোগসূত্র ও দেওয়াল যথাক্রমে মনীষ। মনীষ, সরোনীনির প্রয়াত স্বামী এবং অদিতির পিতৃদেব। শিল্পী সরোজিনীর ভার, তার খ্যাতির বিড়ম্বনা, কর্মপ্রিয়তা সংসারে ফাটল ধরায়। অদিতি যায় বোর্ডিং স্কুলে। মায়ের ভালোবাসা তার কাছে, যান্ত্রিক। কিঞ্চিৎ সামাজিক দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে। তার জীবন চলেছে বাবার আদর্শে। বাবার মতোই ডাক্তারি পড়ে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে সে। মায়ের খ্যাতি থেকে বাঁচতে চাওয়া অদিতি, তেমনভাবে ভেবে দেখলে, মনীষেরই একটি প্রতিরূপ।

অদিতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সরোজিনী। চিত্রনাট্যের অবস্থানে সেও প্রকারান্তরে 'পুরুষ'। লিঙ্গচিহ্নে নারী পরিচয়ের কারণে নানা সামাজিক বাধা সহ্য করেও সংসারের হাল ধরেছে সরোজিনী। গতানুগতিক নারীত্বের কাঠামোতে পড়ে না। সিনেমার একটি পর্যায়ে দেখা যাবে, অদিতির ডাক্তারি পড়ার খরচের কথাটি তুলে আনতে। এনেছে তারই অবচেতন। পরিবারের চলতি সংজ্ঞা ও তার অন্তর্নিহিত সংলাপে, সংসারের প্রাথমিক খরচখরচা 'পুরুষ নিয়ন্ত্রিত'। সরোজিনী ব্যতিক্রম। আদৌ ব্যতিক্রম কি?

সিনেমার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি, অদিতির আত্মহত্যার চেষ্টা। না, মনীষ পারেনি গতানুগতিক সমাজের উল্টোস্রোতে হাঁটতে। সরোজিনীর 'অতিক্ষমতায়ণ' তার সুপ্ত পৌরুষে আঘাত হেনেছিল। নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল সে। ১৯শে এপ্রিল। এই একই তারিখে, প্রত্যাখ্যাত অদিতিও প্রত্যাখ্যাত হয় 'পুরুষে'র দ্বারাই। আদর্শ পরিবার তার তো ছিল না। কিন্ত আত্মহননের মরিয়া চেষ্টাকে বাধা দিয়েছিল সরোজিনী।

এখান থেকেই হয়তো 'পুরুষত্ব', কিংবা 'নারীত্ব'কে ছাপিয়ে গিয়েছে ঋতুপর্ণ-র চিত্রনাট্য। অদিতির অবচেতন থেকে 'মনীষ' ধীরে ধীরে গিয়েছে মুছে। সমাজের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ক্লান্ত সরোজিনী অকপট, তার একমাত্র সন্তানের সামনে। মা-ও মেয়ের বিনিময়, ভেঙে ফেলেছে দৈনন্দিন লিঙ্গবৈষম্যের ভাষাবন্ধন।

কাদম্বরীও কি 'পুরুষ' রবিকেই চেয়েছিলেন? প্রশ্ন থেকে যায়।

Powered by Froala Editor