স্বপ্ন, সন্তান, শিশুশ্রম - এক গতানুগতিক হেরে যাওয়া আমাদের

‘ছেলেটা খালি গেম খেলে জানো! বলে নাকি গেম খেলে রোজগার করবে। কী বলি বলো তো? এরকম হয়?’ এক প্রশ্নে যেন ফিরে গেলাম আটটা বছর পিছনে। যেখান থেকে বুঝতে শুরু করেছিলাম ভালোবাসার দিকে হেলে থাকব সমস্ত ঝড়ের শেষেও। বললাম ‘খেলতে দিন ওকে, ও যদি ওটাকে ভবিষ্যৎ মনে করে, ধরে বেঁধে কেন ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন? নিজের কাজটাকেই তো ভালোবাসবে না কখনও!’ দিদি মুচকি হেসে বললেন, ‘বেশ বলছ যখন, ওর বাবার সঙ্গে কথা বলি…’

সৌভাগ্যক্রমে গতানুগতিকের বাইরে আসতে দেওয়ার মতো একটা পরিবার পেয়েছিলাম। এ-জীবনে বর্তে গেলাম তাই। জন্মের পর মুখের উপর ঝুমঝুমি নাড়িয়ে কেউ বলেনি ক্লাস টুয়েলভ অব্দি ফুটবল খেলবে, তারপর ডাক্তারি! এক অসাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার আমার। বাবা মা দুজনেই শিক্ষক। তাঁরা এতবছর ধরে ছেলেপুলে পড়াচ্ছে, প্রায় একটা কাদার দলা যখন স্কুলে আসে গুটিগুটি পায়ে, তাদের কারুর বাড়ি থেকে ঠিক হয়ে যায় সে উকিল হবে, কারুর বাড়ি থেকে ঠিক হয় ডাক্তার। যে বাচ্চাটি গান চললে হাত পা নাড়ে, বাড়ির লোক ধরেই নেয় সে অভিনয়ে যাবে। অথচ এই পৃথিবীতে ভালো করে নিঃশ্বাস নিয়ে ওঠার আগে তাদের টেক্কার তাস বানানো, এই চলেরও কম বয়স তো হল না! বাচ্চাটি হয়তো স্বপ্ন আর সত্যির তফাত করতে জানে না তখনও। স্বপ্নে একটা বিড়াল রাস্তা আটকালে পিছন ফিরে মাকে দেখতে পায় না, তারপর উঁচু গলায় কেঁদে ওঠে। আমরাও খানিক তাই। কেবল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কান্নার আওয়াজটা নিভে যায় ক্রমে। 

‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক…’

কমবেশি সকলের প্রিয় ও পরিচিত এই লাইন। চোখের সামনে দেখতে পেলেই প্রবল আহাউঁহু। অথচ পিছনে নিজের সন্তানকে ঘোড়া বানাচ্ছি। এই যে ব্যস্ততার পৃথিবী, এই যে ঘোড়দৌড়ের সময়, একটি পা পিছলালেও কোথায় হারিয়ে যেতে হবে কেউ জানি না। কিন্তু বেঁচে থাকা কি মিথ্যা হয়ে যায় তাতে? ধরে নিলাম আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আগে-পরে কিছু একটার জন্য সেসব আর হয়ে উঠল না। আমি সেই না হওয়া নিয়েই একটা গোটা মানুষ। সেই স্বপ্নের ব্যাটন কেউ ভালোবেসে এসে আগ বাড়িয়ে না নিলে, এভাবে জোর করে তা কারোর উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় কি? 

আরও পড়ুন
চোখে ‘ঘুম’ নেই

একজন মানুষ ভালোবেসেছেন, অথবা উল্টোদিকের মানুষটিকে বেছে নিয়ে সংসার পেতেছেন নিজেরাই, তারপর সন্তান এসেছে কোলে, স্নেহের এই ফসলটিকে খোলা আকাশে বাড়তে দেব না আমরা? জীবন কোনো তাসের চাল নয়। আমাদের না হয়ে ওঠার বা হতে চাওয়ার গিনিপিগ হতে সে আসেনি। 

আরও পড়ুন
চিড়-ধরা যৌথ পরিবার, একটা ছাদ ও ঘুড়ির আত্মীয়তা

পিসতুতো দাদা ডাক্তার, অতএব আমার কন্যা ডাক্তার হলে ফ্যামেলি গ্যাদারিং-এ বুক ফুলিয়ে বলতে পারা যাবে। এ নিছক ছেলেমানুষি। যে যা ভালোবাসতে পারে বড় হতে গিয়ে তাঁকে সেটুকুতেই ছেড়ে দেওয়া নয় কেন? যা কিছু ভালোবাসতে পারিনি নিজেরা, তাতে কখনও কি উজ্জ্বল হয়েছি? তাহলে এই ধরে নেওয়া কেন; ‘আমার না করতে পারা আমার মেয়ে, আমার ছেলে করে দেখাবে!’? কেন প্রায় প্রতিটি ঘরে এখনও অনিচ্ছা সত্ত্বে একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে যাবে তারা? যদি তারা সাঁতার কাটতে চায়? যদি কেউ গান নিয়ে থাকতে চায় তবে থাকুক না! কী এসে যায় আমাদের? ওদের বরং বাড়তে দেওয়া হোক। 

আরও পড়ুন
মাঙ্কি বার, শান্ত সন্ধ্যা ও ঠান্ডা পানীয়ের ঠেক

ধরুন একটি মেয়ে বাইক চালাতে চায়, বয়েজ কাট চুল রাখে আর পাড়ার মাঠে হুলিয়ে ক্রিকেট খেলে, ধরুন একটি ছেলে মায়ের সিঁদুর পরা দেখে মুগ্ধ হয়, লুকিয়ে শাড়ি পরে দেখে, কপালে টিপ; কেন অন্য কেউ ঠিক করে দেবে তাকে ছেলে বা মেয়েই হতে হবে? একগাল দাড়ি রেখে চুড়িদার পরতে পারবে না, ১৬ বছর পেরোলে ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে পারবে না? বিপরীত লিঙ্গের কাউকেই বেছে নিতে হবে জীবনসঙ্গী! এসবের ফাঁকে কেবল নিজেদের অসহায়তাই বয়ে নিয়ে চলেছি। আর সন্তানেরা মোট বয়ে চলেছে আমাদের ভালোলাগার! যুগ যুগ ধরে প্রতিভাকে পিস্টনে চেপে মধ্যমেধায় ফিট করিয়ে রেখেছি আমরা। 

আরও পড়ুন
ট্রিগার থেকে শাটারে – এক রঙিন মানুষের বেরঙিন মৃত্যু

এবার বরং বুঝতে শিখি, স্বপ্ন খুবই ব্যক্তিগত। আমার স্বপ্ন চাপিয়ে দিলে আরেকটা ব্যর্থ আমিই উপহার দেব পরের প্রজন্মকে। শিশুকে বরং স্বপ্ন দেখাতে শেখাই আমরা! সে যা ভালোবাসে করুক। যে ছেলেটি কনস্ট্রাকশন সাইটে ইট বইছে বা যে মেয়েটি আপনার গাড়ির জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে চায়ের কাপ, ওই গাড়িরই ভিতরে বসা আপনার সন্তানও মানসিকভাবে একইরকম পরাধীন, কেবল তার বেঁচে থাকার বাইরে যে চাকচিক্য, যে আস্তরণ তাকে চটজলদি কেউ করুণা করবে না! মা-বাবার ইচ্ছার চাপে সন্তান শিশুশ্রমিক হয়ে উঠছে। প্রত্যাশার বোঝা টানতে হাতে কড়া পড়ে যাচ্ছে তাদের। ওদের জীবনটা বরং ওদেরই বাছতে দিই। শান্তির নিঃশ্বাস নিক। অনেকদিন হল…

আরও পড়ুন
গোলাপি সাইকেল ও রঙিন ছেলেবেলার নব্বই

 

Powered by Froala Editor