লকডাউনের পর থেকেই কলকাতার বুকে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে একদল ছাত্র-যুবক। তাদের মিলিত উদ্যোগের নাম ‘কোয়ারেন্টাইন স্টুডেন্টস ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’। উদ্যোগটা শুরু হয়েছিল কাজ হারানো হতদরিদ্র মানুষের মুখে নিয়মিত খাবার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সেখানেই আটকে থাকেনি এই ছাত্র-যুবরা। কারণ খাবারের পরেই আসে শিক্ষার প্রশ্ন। সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষই যেখানে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, সেখানে সেই দায়িত্বও অস্বীকার করা যায় কি? অস্বীকার করতে পারেনি তারা। আর তাই জন্ম নিল 'পৃথিবীর পাঠশালা'। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে বেরিয়ে একটু অন্যভাবে পৃথিবীকে চেনার চেষ্টা।
এমন একটা উদ্যোগের সম্পর্কে জানতে প্রহরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী স্বাগত চক্রবর্তী জানালেন, "পড়াশুনো তো শুধু বইয়ের পাতায় আটকে থাকে না। আমরা আমাদের সারাদিনের অভিজ্ঞতা থেকে যা কিছু শিখি, তাকেই বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী মানসিকতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করছি আমরা। এই পৃথিবীই তো আমাদের পাঠশালা।" আর এই জীবন্ত শিক্ষার সঙ্গে তাই সহজেই একাত্ম বোধ করতে পারে সেইসব স্কুলছুট পড়ুয়ারা, যাদের কেউই বইয়ের নির্জীব শিক্ষার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। কেউ কোনোরকমে পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা সেই পাঠ চুকিয়েছে। বাবার ভ্যান রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে বা রোজগারের আশায় পাড়ি দিয়েছে ভিনরাজ্যে। তবে লকডাউনের সময় সবাই ফিরে এসেছে। আর তারাই এখন এই পাঠশালার পড়ুয়া।
একমাস আগে বাঁকুড়ার পাত্রসায়র এলাকাতেই প্রথম শুরু হয় একটি স্কুল। আর সপ্তাহ খানেক আগে কলকাতার কালিকাপুর, রুবি, বাঘাযতীন এবং পাটুলি অঞ্চলে শুরু হয় একইরকমের পাঠশালা। আর কিছুদিনের মধ্যেই কলেজ স্ট্রিট এলাকাতেও শুরু হতে চলেছে একই উদ্যোগ। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসিফ আবদুল্লা জানান, "বাঁকুড়ার খবর শোনার পরেই আমরা এমন একটা কিছু করার কথা ভাবছিলাম। এখানেও তো কলাবাগান এলাকার বস্তির অবস্থা একইরকম।" আর তাই ১২ জুলাই ৬০-৭০ জন অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি হল কলেজ স্ট্রিট এলাকার পাঠশালার রূপরেখা। তাছাড়া আগস্ট মাস থেকেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাসনাবাদ-সন্দেশখালি অঞ্চলেও শুরু হতে চলেছে একই উদ্যোগ। আর সবটাই পরিচালনা করছে কোয়ারেন্টাইন স্টুডেন্টস ইয়ুথ নেটওয়ার্ক।
আরও পড়ুন
শিশুশ্রমিকদের নিয়ে তৈরি স্কুল, লকডাউনের দীর্ঘ ছুটিতে কেমন আছে তারা?
আরও পড়ুন
দারিদ্র্য বাধা নয় মুক্তচিন্তার, পরিবেশ দিবসে প্রমাণ করল চিত্তরঞ্জনের প্রান্তিক পড়ুয়ারাই
তবে লকডাউন তো একদিন শেষ হবে। আবারও প্রতিদিনের কাজে ফিরতে হবে সবাইকে। তখন আর এই পড়াশুনো চলবে কি? স্বাগত বললেন, "অনেকেই প্রশ্ন করছেন, কাজ না করলে কি আপনারা খাওয়াবেন? না, আমরা তো মিড-ডে মিল চালাতে পারব না। কিন্তু মিড-ডে মিল দিয়েও তো স্কুলের শিক্ষায় আটকে রাখা যায়নি তাদের। রোজগারের আশায় সবাইকেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে।" এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়াশুনো কি সত্যিই বিলাসিতা? নাকি এর মধ্যেই নতুন সময়ের স্বপ্ন বোনা যায়? এই পাঠশালার ভবিষ্যত কী, তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে এই পথচলাটুকু সত্যিই প্রয়োজন ছিল।
আরও পড়ুন
‘প্রতিবন্ধী’ হলেই হেনস্থা বা করুণা, প্রান্তিকতাই চাপিয়ে দেয় 'স্বাভাবিক' সমাজ?
আরও পড়ুন
শ্বেতী-আক্রান্তরা প্রান্তিক নয়, নাতনির জন্য পুতুল তৈরি করে বার্তা দাদুর
Powered by Froala Editor