ব্যস্ত শহরের মধ্যেই ছিল পারমাণবিক চুল্লি, জানতেন না কেউই

ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন (London), প্রতি মূহুর্তে লেগে রয়েছে শহরবাসীর ব্যস্ততা। কেউ কাজে, তো পড়াশোনার সূত্রে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই ভিড়ে ঠাসা শহরের মধ্যেই রয়েছে গ্রিনিচের (Greenwich) বিখ্যাত ‘ওল্ড রয়াল ন্যাভাল কলেজ’ (Old Royal Naval College)। ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর নানা গবেষণা চলে এখানে। তার কিং উইলিয়ামের নামাঙ্কিত বাড়িটির সঙ্গেও জড়িয়ে অসংখ্য ইতিহাস। সে বিষয়ে জানে না, এমন লোক হয়তো সাধারণ লন্ডনবাসীর মধ্যে হাতে গোনা। তবে তারা যেটা জানত না, সেটা হল এই বাড়িতেই রাখা আছে একটি সক্রিয় পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor)। হতে পারে তার শক্তি অল্প, তবু এক অজানা পারমাণবিক বিপদকে সঙ্গে নিয়েই তিরিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছিল লন্ডনবাসী।

নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরটির নাম ‘জেসন’ (JASON)। গত শতকের ছয়ের দশকে রয়্যাল ন্যাভাল কলেজ এই ছোট চুল্লিটি নিয়ে আসে ‘হকার সিডলে’ কোম্পানি থেকে। চুল্লিটি অবশ্য বানানো হয়েছিল আমেরিকার আরগোনে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। মাত্র ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতা তার, মূলত ব্যবহার করা হত গবেষণার কাজেই। যদিও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ‘জেসন’-কে ব্যবহার করা যেত পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনেও। ১৯৬২ সালে সিডলে কোম্পানি যখন বন্ধের মুখে তখন পড়ুয়াদের হাতেকলমে শিক্ষার জন্য এটি নিয়ে আসা হয় গ্রিনউইচে। মাত্র ১২ ফুট উচ্চতা তার। তিনশো টনেরও বেশি ওজনের কংক্রিটের দেওয়াল তৈরি করে প্রতিহত করা হত নিউট্রনের নিঃসরণ। তা সত্ত্বেও কিন্তু যথেষ্ট বিপজ্জনক ছিল জেসন। আর পাঁচটা সাধারণ ব্যবসায়িক চুল্লির থেকে অন্তত তিরিশ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয় ছিল সে। ফলে গোটা লন্ডন শহরই বসেছিল একটা টাইম বোমের উপরে। যত বছরই লাগুক না কেন, উড়িয়ে দেওয়া যায় না বিস্ফোরণের সম্ভাবনা। স্বাভাবিকভাবেই কলেজ কর্তৃপক্ষ বেমালুম চেপে গেছিল পারমাণবিক চুল্লির বিষয়টি।

আর স্থানমাহাত্ম্যেও তো জুড়ি নেই জেসন-এর। সপ্তদশ শতকে লন্ডনের অগ্নিকাণ্ডের পর শহরটিকে যাঁরা নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন স্থপতি ক্রিস্টোফার রেইন ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধানতম। সেন্ট পলস চার্চ ছাড়াও হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস, ট্রিনিটি কলেজের লাইব্রেরি, রয়্যাল ল্যাবরেটরিতেও ছিল তাঁর হাতের কেরামতি। ১৬৯২ সালে রেইনের পরিকল্পনাতে শুরু হয় অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের জন্য গ্রিনিচের হাসপাতাল। অবশ্য ‘হাসপাতাল’-এর বদলে এটাকে অতিথিশালা হিসেবেই ব্যবহার চলত বেশি। ১৮৬৯ পর্যন্ত সক্রিয় থাকার পর এখানেই গড়ে ওঠে রয়্যাল ন্যাভাল কলেজ। ১৯১৪ পর্যন্ত চলে নবাগতদের শিক্ষনবিশীর কাজ। পরে শুধুমাত্র নৌবাহিনীর যুদ্ধব্যবস্থার প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত গবেষণার জন্যই বেছে নেওয়া হয় গ্রিনিচের এই জায়গাকে। 

মজার বিষয় হল ‘জেসন’-এর আগমনের পরের বছরেই গ্রিনিচকে ঘোষণা করা হয় ‘নিউক্লিয়ার শূন্য’ বলে। এমনকি ওখানকার সাধারণ কর্মচারীরাও জানতেন না কার সঙ্গে নিত্য দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে তাদের। প্রচলিত ছিল যে, এটি একটি অতিসাধারণ নমুনা বিশেষ, তেজস্ক্রিয়তার সঙ্গে দূরদূরান্তে সম্পর্ক নেই এটির। আর এভাবেই কেটে যায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময়।

আরও পড়ুন
ভাঙা পড়ছে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’, কেন?

অবশেষে ১৯৯৬ সালে নৌ-কর্তৃপক্ষ ঠিক করে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে সম্পূর্ণ কলেজটিকে। একই সঙ্গে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্থাপত্যটির দরজা। যার অর্থ বিদায় নিতে হবে জেসনকেও। কাজটা অবশ্য একেবারেই সহজ ছিল না। সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করে নিষ্ক্রিয় করা হয় চুল্লিটিকে। এর আগে পর্যন্ত ইংল্যান্ডে কোনো পারমাণবিক চুল্লির যন্ত্রাংশ খুলে নিষ্ক্রিয় করা হয়নি। ফলে সেটাও ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। তিন বছরের চেষ্টায় এবং ২৭০ টন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উগরে দিয়ে তবে বিদায় নেয় জেসন। বর্তমানে তাঁর স্থান হয়েছে অ্যাসকটের ইমপেরিয়াল কলেজের সংগ্রহশালায়।

আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম নিরপেক্ষ বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনের পত্রিকায়

ইউরোপের ন্যায়-আদালতে একটি অভিযোগও দাখিল করা হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আইনের ফাঁক গলে সেটি অবশ্য উঠে যায় কিছু বছর পরেই। তবে সম্ভাব্য যে বিপদ নিয়ে বছরের পর বছর ঘর করেছে লন্ডনের অধিবাসীরা, তার উত্তর আদৌ কেউ দিয়েছিল কিনা সন্দেহ। 

Powered by Froala Editor