মার্কিন এয়ার ফোর্সের প্রাক্তন কর্নেল ব্রুস হলিউড জন্মসূত্রে আমেরিকান নন। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা একটি মার্কিন সেনা পরিবারেই। সেটাকেই তিনি নিজের পরিবার বলে জেনেছেন। পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন পালক পিতার জীবিকাকেই। এমনকি সেই মার্কিন দম্পতি যখন তাঁকে বারবার বলেছেন তাঁর নিজের মায়ের সন্ধান করতে, তখনও খুব একটা ঔৎসুক্য বোধ করেননি কর্নেল হলিউড।
এর মধ্যেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল একদিন। হঠাৎ হৃদযন্ত্রের আক্রমণে হাসপাতালে যেতে হল কর্নেল হলিউডকে। তখন অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে কাতর অবস্থাতেই নিজের মায়ের প্রতি টান অনুভব করলেন তিনি। সেই জাপানি মহিলা, যাঁর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন ব্রুস। তারপর ষাটের দশকে একটি যুদ্ধের সময় নিঃসন্তান হলিউড পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের ছোট্ট শিশুকে। প্রায় চারটি দশক পর করে সেই মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইলেন ব্রুস।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর অনেক খোঁজ করার চেষ্টা করলেন তিনি। আমেরিকার জাপানি দূতাবাসে গিয়ে বহু তত্ত্বতালাস করার পরেও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। তাঁর পালক বাবা-মা মারা গিয়েছেন ইতিমধ্যে। অতএব সেখান থেকেও কোনো সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। অবশেষে তিনি যখন একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন এগিয়ে এলেন জাপান সেনাবাহিনীর এক সদস্য। একটি বারে বসে একদিন ব্রুসের কাছে তাঁর ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথা শুনলেন তিনি। আর তারপরেই একদিন ব্রুসের কাছে ফোন এল জাপান দূতাবাস থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোনের ওপারে পাওয়া গেল তাঁর জন্মদাত্রী মাকে। নবুই আউচি, যাঁর বয়স তখন ৬৫ বছর।
ফোন যোগাযোগ তো সম্ভব হল, কিন্তু আউচি তো ইংরেজি বলতে পারেন না। আর ব্রুস নিজেও জাপানি ভাষা জানেন না। ফলে প্রথমে কথা চলল ইন্টারপ্রেটার যন্ত্রের সাহায্যে। ব্রুস জানতে পারলেন, পরদিন তাঁর মায়ের জন্মদিন। তারপর তিনি সোজা বিমানে চড়ে রওয়ানা দিলেন জাপানের উদ্দেশ্যে। আউচিও আমেরিকায় এলেন কয়েকবার। ক্রমশ দুজন দুজনের ভাষা শিখলেন। আসতে আসতে পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে লাগলো। মাতৃত্বের বন্ধন যে বড় কঠিন বন্ধন।
নিজের মাকে ফিরে পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছিলেন ব্রুস। জাপানে গিয়ে দেখলেন, তাঁর মায়ের মালিকানায় থাকা বারের নাম ব্রুস। ছেলের নামেই নাম রেখেছেন তিনি। এত বছর ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন এই মহিলা! ভাবতে গিয়ে অবাক হলেন তিনি। এরপর একদিন একটি চিরকুটে তাঁর জন্মদাতা বাবার নাম লিখে দিলেন আউচি। সেখানে গিয়ে ব্রুস সন্ধান পেলেন, তাঁর আরও একজন ভাই আছে। সেই ব্যক্তিও যেন একজন ভাইয়ের প্রতীক্ষায় ছিলেন। ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এলেন তাঁরা। এর মধ্যেই কেটে গিয়েছে আরও ৫ বছর। একটি ভেঙে যাওয়া পরিবার জোড়া লাগতে লেগে গেল ৪৫ বছর। আজ প্রশান্ত মহাসাগরের দুধারে তাঁদের সুখের সংসার। তবে আজও ব্রুসের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সেই ৫ বছর আগে ইন্টারপ্রেটারে শোনা কথাটা, "আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে।" এই প্রতীক্ষায় হয়তো মানুষকে ফিরিয়ে আনে। এই পৃথিবীতে কিছুই কি হারিয়ে যায়?