সৎ পাণ্ডিত্য প্রথম পৃথিবী ছোঁয়া আলোর রেখার মতো। আর সেই সঙ্গে রসবোধ এনে দেয় ব্যক্তিত্বের মানবিক প্রকাশ।
'রেঁনেসা'র চরমমান যে সমস্ত বাঙালিরা ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলেন সাধারণকে পথের পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে— স্বপন চক্রবর্তী তাঁদের অন্যতম।
'সুভদ্রকুমার সেন স্মারক বক্তৃতা'য় তিনি অনায়াসে বলতে পারেন— সংস্কৃতজনের অবশ্য কর্তব্য ইতরজনের বাক-এর প্রতিও সংবেদনশীল হওয়া।
ক্রমাগত শিক্ষকশূন্য হয়ে পরছে এই বাংলা— রাতের আকাশ যখন ঘড়ির দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘন হচ্ছে, ২৬শে সেপ্টেম্বর মনে করিয়ে দিচ্ছে বিদ্যাসাগরের জন্ম মুহূর্তের কথা— তখন আমাদের শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তীর কথা আমি লিখছি একলা হয়ে। আসলে একজন মহান শিক্ষক বহুমুখী 'কথা'র সমাহার যা আসলে দর্শনের সমান।
পড়াশুনায় ক্রমশ বিরল হয়ে আসা বাঙালির জন্য যারা খুব হতাশা করেন তাদের জন্য তিনি বলতে পারেন "অবস্থাটা একদিনে এরকম হয়নি। মানবিকীবিদ্যার চর্চার মৌল রসদ সংগ্রহে ও সংরক্ষণে কেউ আগ্রহ দেখাননি বহুদিন— না সরকার, না নাগরিক সমাজ।"
খুব অন্ধকার লাগছে বলে আজ আর চিৎকার করব না আমি। এখনই সময় সেই সমস্ত ফেলে রাখা পাঠকে পুনঃপাঠের দিকে নিয়ে যাওয়ার। স্বপন চক্রবর্তীর লক্ষ্য তো শিক্ষা, সাহিত্য, কিংবা ইতিহাসকে সামাজিক করার দায়িত্ব নেওয়া।
'বাঙালির ইংরেজি সাহিত্যচর্চা' বইটিকে যেন আমরা শুধু মাত্র ইংরেজি সাহিত্য পাঠের প্রাথমিক গ্রন্থ না ভাবি। এই বই আসলে আমাদের মনে করিয়ে দেয় ঠিক কোন মুহূর্তে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এক উঠোনে এসে দাঁড়াতে পারে।
আজ খুব দুঃখ করার দিন নয়। অনেকগুলো দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার দিন। অন্ধ প্রায়-কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে ‘শিক্ষিত করার দায়িত্ব বিদ্যাজীবীদের, যাঁরা কিনা সত্যের মালিক ও সংরক্ষক’।
২০১১ সাল। সদ্য ইংরেজি সাহিত্যের দেওয়ানি আম-এর দরবারে বসেছি। মাস্টারমশাই রাজর্ষি মুখোপাধ্যায় একদিন শেক্সপিয়রের জীবন ও নাট্যকাহিনি শোনাচ্ছিলেন। এমন সময় বললেন “আমার স্যার ছিলেন স্বপন চক্রবর্তী। স্যারের শেক্সপিয়র নিয়ে আলোচনা শুনলে মনে হবে জীবনে কিছু একটা অর্জন করলাম।" প্রথম এল জীবনে এই নাম— মনে মনে ইচ্ছে ছিল একদিন শেক্সপীয়রের আলোচনা যেন শুনতে পাই ওঁর সামনে বসে। প্যপিরাস থেকে 'শেক্সপিয়র'-এর জীবনী কিনে পাঠ করলাম— সবটা বুঝিনি সেদিন। বিষয়টা বোঝার সুযোগ হয়ে গেল আট বছর পর— প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'শেক্সপিয়র সেমিনার'-এ যোগদান করার সুযোগের মধ্যে দিয়ে। শিখলাম পরিচিত ও অপরিচিত ভাষার ব্যবধানে কীভাবে সাহিত্যের ব্যপ্তি তৈরি হয়, ইংল্যান্ডের জীবন থেকে উঠে শিল্পীর বোধ কিভাবে ক্ষমতা ও ইতিহাস লেখার রসদ তেরি করছে।
সাহিত্যের ইতিহাসে টমাস মিডলটনের নামের সঙ্গে একটা ‘awe and reverence’ মেশা থাকে স্বপন স্যরের চিন্তার পরিসরে।
তাঁর আলোচনা আসলে তো স্মৃতির উচ্চারণ। সঙ্গে যুগপৎ আনন্দ, রসিকতা আর বিষাদকে পার করে যাওয়ার পথের পথিক। নতুনের ভাবনাকে কেমন করে মঞ্চের দাঁড় করাতে হয়, সে শেখানোর দায় যে একজন শিক্ষকের, সেই কাজ শেষ দিন পর্যন্ত তিনি করে গেছেন।
শ্রদ্ধাহীন পৃথিবীতে একজন শিক্ষকের সাবধানবাণী কানে আসে "কল্পনার, সংবেদনের, বিতর্কের প্রসার ছাড়া বিদ্যা তো ক্ষমতার গোলাম।"
'পুরানো চাল' নামে কলাম লিখেছিলেন একবছর এক পত্রিকায়। সেখানে ছিল নিজের জীবনের মধ্যে দিয়ে বাংলার জীবনকে দেখার চেষ্টা। যেন তাঁর চিন্তার প্রতিফলন "ভাষার জীবন নিহিত থাকে লোকযাত্রায়"।
শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়, চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নাটক, রাজনীতি, সমাজ, সাংবাদিকতা সমস্ত বিষয়েই একটা নিবিড় বিশ্লেষণ এবং শাণিত বক্তব্য ভাবতে বারবার সাহায্য করেছে। প্রাক্তন মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটনের কলকাতা সফরের সময় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সেক্রেটারি কিউরেটর হিসেবেও যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি ও তদারকির দায়িত্ব সামলেছেন। বিদেশি অতিথির কাছে কলকাতার মান আপনি উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন।
আকাশবাণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বপন চক্রবর্তী এবং ভাস্বতী চক্রবর্তীর কথালাপ আকাশবাণীর শ্রোতাদের সমৃদ্ধ করেছে।
গ্রন্থ, গ্রন্থনা ও সম্পাদনার ইতিহাস নিয়ে সম্পাদনা করা বই 'মুভেবল টাইপ’ এবং 'মুদ্রণ সংস্কৃতি ও বাংলা বই' সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি জনপদ আবিষ্কার। প্রযুক্তির পৃথিবীতে পাঠ প্রযুক্তি কেমন হবে তার দিশা যেন শেষ ক-বছর উনি তৈরি করেছেন বিভিন্ন প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে। স্বপন চক্রবর্তীকে যদি ভাবেন শুধুমাত্রই একজন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক কিংবা বিদেশে গবেষণা করেছেন আর খুব বেশি হলে জাতীয় গ্রন্থাগারের ডিরেক্টর— তাহলে খুব ভুল ভাবছেন আপনি, উনি আসলে কোথাও না কোথাও একজন 'সাংস্কৃতিক প্রযুক্তিবিদ' বা কালচারাল ইঞ্জিনিয়ার-এ নিজের অবস্থানকে তৈরি করেছিলেন— "পেশার খাতিরে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন গ্রন্থাগার পরিকল্পনা ও নির্মাণের কাজে নিযুক্ত আছি। এসব কাজ ভালো লাগে— এর আগে প্রেসিডেন্সির মিউজিয়াম বানিয়েছিলাম। কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর প্রশাসনের কাজের সঙ্গেও আমার যোগ রয়েছে। মুম্বইয়ের এস পি জৈন স্কুল অফ গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ –এ ডিস্টিংগুইশ্ড্ ভিজিটিং ফ্যাকালটি হিসেবে যোগ দিয়েছি। হিউম্যানিটিজ-এর লোকরা টেক্সট বা পাঠ্যবস্তুকে কীভাবে দেখি আর কীভাবে দেখেন তথ্যবিজ্ঞানীরা, এই বিষয়ে দ্বৈত ভাবে পাঠক্রম তৈরি করেছি দেবাশিস গুহের মতো বিজ্ঞানীর সঙ্গে। আশা করছি, অভিজ্ঞতাটির থেকে কিছু সঞ্চয় বাড়বে।" এমন একজন বিশ্ববোধ সম্পন্ন শিক্ষকের আলোই তো মননের আলো, চিন্তা ও অস্তিত্ত্বের আশ্রয়।
এইজন্যই চিন্ময় গুহ বলছেন, "দ্য লাস্ট ইন্টালেকচুয়াল অফ ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট।”
Powered by Froala Editor