যে লেখা লিখব বলে ভাবিনি কখনও

কোনো কোনো মানুষ থাকে, যারা চলে গেলে কোনোরকম শোকবার্তা লেখা সত্যিই দুরূহ। কারণ একটাই। এরা আসলে কক্ষনো চলে যায় না, যেতেই পারে না! সবসময়েই রয়ে যায় নিজেদের অনুপস্থিতিকে প্রবল এক অদৃশ্য উপস্থিতিতে বদলে দিয়ে।

শীর্ষর সঙ্গে আমার প্রাথমিক আলাপ কিন্তু ফেসবুকেই। তখন কলকাতায় নিজের কাজের কারণে নিয়মিত যেতাম। কলকাতার বাড়িতে থাকাকালীন একদিন কিছু একটা লেখা পড়ে ওকে বন্ধুত্বের আবেদন পাঠিয়েছিলাম। সঙ্গেসঙ্গেই তা গ্রহণ করল এবং আমাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা সেই যে শুরু হল, অতি অনায়াসেই পরবর্তীকালে তা খুব দ্রুত পৌঁছে গিয়েছিল অটুট বন্ধুতায়। আরও অনেক কিছু কারণ ছিল হয়তো। আমরা দুজনেই উত্তর কলকাতার, দুজনের বড়ো হয়ে ওঠা মোটামুটি একই প্রেক্ষাপটে। একটা কথা বরাবরই বিশ্বাস করি আমি, সুন্দর সখ্য তখনই দু-জন মানুষের মধ্যে সম্ভব, যখন তারা সমমনস্ক হয়। চিন্তাভাবনা, পছন্দ-অপছন্দের কম্পাঙ্ক না মিললে সে বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমরা একইসঙ্গে সেই কম্পাঙ্ক স্পর্শ করতে পেরেছিলাম।

বন্ধুত্ব গাঢ় হল আরও। তারপর থেকে যতবারই কলকাতায় গেছি, যেভাবেই হোক একবার অন্তত সময় বার করে আমরা কোথাও না কোথাও বসে দুপুরের খাবার খেতাম। ঘণ্টা দুই নির্ভেজাল আড্ডা। কখনও পার্ক স্ট্রিটের কোথাও, কখনও বা অন্য কোনো অঞ্চলের রেস্তোরাঁয়। সেই সব রোদেলা দুপুরে ড্রাই চিলি পর্ক বা বেকড আলাস্কা খেতে খেতে বা কখনও কখনও ‘আজকাল’ অফিসের ক্যান্টিনে সন্ধেবেলায় কড়া লাল চায়ের সঙ্গে ঠান্ডা শিঙাড়া আর চামচিকের মাপের মশার কামড় হজম করতে করতে জমে থাকা যত রাজ্যের  খবরাখবর দেওয়া-নেওয়া করতাম আমরা। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হল, আমাদের দুজনের এইসব নিয়মিত আড্ডায় ঠিক কী কী নিয়ে কথা হত, আলটপকা বলা খুব মুশকিল! কী নিয়ে কথা বলতাম না, তা ব্যাখ্যা করতে হলেও গালে হাত দিয়ে ভাবতে হবে।

শীর্ষ লিখত। ফিকশন এবং নন-ফিকশন। ঝরঝরে, মেদহীন ঋজু কলম ছিল তার। আমি বলতাম, ‘সাংবাদিক মানুষ তো! ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম রক্তে এমনই মিশে গেছে, যে ললিতলবঙ্গলতামার্কা মাখোমাখো লেখা তোমার দ্বারা হবেই না কখনও।’ অবশ্য ওর স্বভাবের সঙ্গে অমন লিখনশৈলি মানাতও না। সোজা কথা স্পষ্ট উচ্চারণে বলে আসাটাই অভ্যেস ছিল। চাটুকারিতা, পরশ্রীকাতরতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস বা হা-হুতাশ সবকিছুই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল।

আরও পড়ুন
নেশার নাম ক্যামেরা

শীর্ষর প্রতিটি লেখা পড়তাম আমি। এবং তা নিয়ে কাটাছেঁড়াও করতাম ঢের। এই যে এত বই কিনি, ওর একটি বইও কিন্তু কিনিনি আমি। প্রতিটি বই উপহার দিয়েছে ভালোবেসে। এমনকি যখন ‘শার্দূলসুন্দরী’-র ইংরিজি ভাষান্তর বেরোল, সেটাও একদিন হাতে করে নিয়ে এল আমার জন্য। বলল, ‘এটাও রাখো। ইংরিজি অনুবাদ, অন্য কেউ করেছে... তাতে কী! এটাও তো আসলে আমারই!’   

আরও পড়ুন
মহামারী পরিস্থিতিতে শঙ্খ ঘোষকে ভার্চুয়াল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন কলকাতার শিল্পীসমাজের

শুধু একটি বইতেই নাম লিখে দেয়নি। ‘জলের ওপর দাগ’। বলল, ‘থাক, এটার ভেতরে কিচ্ছু লিখব না! যখনই খুলবে বইটা, মনে মনে আমাকে গালমন্দ করবে লিখে দিলাম না বলে।’

আরও পড়ুন
জার্মান ভাষায় রবীন্দ্র-কবিতা, পাঠোদ্ধারে সহায় শঙ্খ ঘোষ

আপাদমস্তক সৌখিন মানুষ ছিল শীর্ষ। কতবার বলেছি, ‘তোমাকে দেখে বোঝা যায় উত্তর কলকাতার বনেদি বাবু-কালচার কী বস্তু!’

‘এক নম্বর পাঁচু মিস্ত্রি লেন’ পড়ে মন্তব্য করেছিলাম, ‘সকলে তো শার্দূলসুন্দরী, রমণীরতন নিয়ে কত কথা বলে! আমার কেন জানি না মনে হল, এই লেখাটাতে তুমি একেবারে তোমার মতো করে আছ! এটা লিখতে তোমাকে কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি আলাদা করে; জলের মতো সহজভাবে বয়ে গেছে। একটাই কারণে, এইসব চরিত্রদের সঙ্গে নিয়েই তোমার বড়ো হয়ে ওঠা।’

বলেছিল, ‘একেবারে ঠিক বলেছ!’

পরিণত বয়সে ‘বন্ধু’ পাওয়া যায় না তেমন। অধিকাংশই ‘পরিচিত’র গণ্ডি পেরোতে পারে না। তবু কখনও কখনও আচমকা খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে কেউ কেউ। শীর্ষও তেমনই ছিল।

এই ‘ছিল’ কথাটা বাক্যের শেষে যোগ করতে হবে আজ, ভাবিনি কখনও।

এও তো ভাবিনি, এখন থেকে আমাদের মুখোমুখি আড্ডা ফুরিয়ে গেল। এখন থেকে মনে মনেই অফুরন্ত গল্প হবে শুধু। নতুন লেখা তো পাব না আর; পুরোনো লেখাগুলো ফিরে ফিরে পড়ব যখন... হয়তো নতুনভাবে তার ব্যাখ্যা করব নিজের কাছে। মনে মনেই তা জানিয়ে দেব আমার বন্ধুটিকে, আমার প্রিয় কলমচিকে। 

কতবার বলেছি, ‘একটু বেশি বেশি করে গল্পটল্প লেখো না কেন আমাদের জন্য?’ উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ‘দূর, বেশি লিখে কী হবে? যদি আমার লেখা থেকে যাবার মতো হয়, ঠিকই থেকে যাবে।’

শীর্ষ কতটা বন্ধু ছিল আমার? এই যে অগুনতিবার আমাদের দেখা হল, গল্প হল... কোনো ছবিও নেই কিন্তু! ছবিটবি তুলে রাখার কথা আমরা কেউ ভাবিইনি কখনও!

আসলে আমরা ধরেই নিই, সামনে অনেক অনেক দিন বাকি আর অনেকটা পথ পড়ে আছে। অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে খেয়াল করি না, কখন হঠাৎ করে রাস্তাঘাট ফুরিয়ে যাবে আর সামনেই দেখব একটা অন্ধকার আর অতলস্পর্শী খাদ।

তোমার সঙ্গে আলো আছে, না নেই... জানি না শীর্ষ!
বাকি পথটুকু...
সাবধানে যেও।

Powered by Froala Editor

More From Author See More