দেখা হওয়ার বহু আগে তাঁকে নিয়ে লিখেছিলাম কবিতার মতো এমন কিছু একটা:
'হৃৎকমল খুঁজছিলেন শঙ্খ ঘোষ,
পেলেন ধাতব কলকাতা'।
অদেখা কলকাতাও আমার কাছে শঙ্খ ঘোষ-বিহীন ছিল না। আর যখন একদুপুরে শোনা গেল তিনি আসছেন ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরপাল্লার বাসে চড়ে চলে এসেছি ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে; মনে আছে-মেঝেতে বসে সমুখের গোলাকৃতি সমাবেশকে বলছিলেন তিনি বরিশাল আর পাকশীর গল্প। ফেলে আসা সময়ের ঘ্রাণ বিলি করে তিনি তো চলে গেলেন কিন্তু আমাদের ভেতর বয়ে গেল মায়ারহস্যের নদীপথ। শঙ্খ ঘোষের সন্ধ্যানদীর জল।
সেই জলতৃষ্ণা যে একদিন কলকাতার ঘোর ডাঙায় গিয়ে মুক্তি খুঁজবে - তা ভাবিনি কখনও। তবে তাই হল। ২০১৫-এর এক রবিবারের আড্ডায় প্রথম যাওয়া, বিদ্যাসাগর আবাসনের সে বিদ্যাসাগর-জীবনীকার কবির বাসায়। প্রথম আলাপের পর আমার শশব্যস্ত উঠে পড়া কারণ স্বল্পকালীন ভ্রমণে তার পরপরই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা পার্ক স্ট্রিটের ফ্লুরিজে। রবিবারের ধুম আড্ডার মধ্যিখান থেকে ওঠে দুয়ার অব্দি এগিয়ে দিয়ে, বিদায় জানিয়ে বলা, 'ফ্লুরিজ আমার পছন্দের জায়গা কিন্তু। আবার এসো।'
আরও পড়ুন
জার্মান ভাষায় রবীন্দ্র-কবিতা, পাঠোদ্ধারে সহায় শঙ্খ ঘোষ
আরও পড়ুন
সাত দশক ধরে আয়ুধ সরবরাহ করেছেন বাঙালিকে
আহা, এই একটি কথার রূপাভিঘাতে তারপর যতবার কলকাতা যাওয়া ততবার শঙ্খ-সন্দর্শন। তাঁর সঙ্গে দেখা না হওয়া অব্দি কলকাতা একরকম, দেখা হলে পর আরেকরকম।
আরও পড়ুন
বঙ্গসমাজের শেষ আলোকবর্তিকা
একবার বললেন, ঢাকায় ফেরার আগে বিকেলের দিকে একটু আসতে পার? তিনি বলেছেন আর আসব না! যথাসময়ে দেখি, আমার সঙ্গে কেন্দ্রীয় শিক্ষা কমিশনের পদস্থ একজনও হাজির। নিজের কাজের কথা বলতে ব্যাকুল ভদ্রলোককে আমার উপস্থিতিতে উষ্মাশীল দেখে শঙ্খ ঘোষ মৃদুকণ্ঠে শুনি আমার পরিচয় দাখিল করা শুরু করেছেন, যেন বয়সে ছোটো বলে হেলা না করা হয় আমাকে। বিব্রত আমি অবাক হয়ে ভাবি তাঁর হৃৎপ্রসারতা। সেদিন আমাকে ঢাকায় একটি জরুরি কাগজ পাঠাতে ডেকেছিলেন, খুব দ্রুত আমার মাধ্যমে তা প্রাপকের হাতে পৌঁছে যাওয়ায় তাঁর ধন্যবাদ পেতেও দেরি হয়নি।
একবার ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে রবি-আড্ডার জনাকয় কবি বাংলাদেশ নিয়ে তীর্যক দু'একটা কথা বলেছে কি বলেনি, শঙ্খ ঘোষ তৎক্ষণাৎ বললেন, 'পিয়াসকে বসিয়ে রেখে এই কথাগুলো বলছ!' বিস্মিত আমি ভাবি, তিনি শঙ্খ ঘোষ; তিনি ছাড়া আর কে জানেন প্রবাসে যেকোনো মানুষের বুকজুড়ে বহতা থাকে নিত্য স্বদেশ।
তাঁর সমসাময়িক কবি সৈয়দ শামসুল হক কর্কট ব্যাধিতে ভুগে চিকিৎসাধীন ছিলেন লন্ডনে। কলকাতায় গিয়ে ফোনে ধরিয়ে দিলাম তাঁর প্রিয় বন্ধু শঙ্খ ঘোষকে। আমি আপ্লুত আজও, সৈয়দ হকের প্রয়াণের পর আমারই আহ্বানে তিনি সে আলাপনকে উপজীব্য করে লিখলেন এক অবিস্মরণীয় কবিতা 'কথা হবে।'
২০১৯-এর একুশে বইমেলায় সম্মানিত অতিথি হয়ে ঢাকায় এলেন। সেমন্তীদিসহ উঠলেন রবীন্দ্র-সরোবর-লাগোয়া নাহাস ভাই আর রূপাদির বাড়িতে। বইমেলার ব্যস্ততা কাটিয়ে যেন রাতের দিকে আসি, বললেন কারও মারফত। শিল্পী বুলবুল ইসলাম আর শারমীন সাথী ইসলাম ময়নার সুরকল্লোলে তাঁর শান্ত বসে থাকা কত যে শান্তিদায়ী ছিল আমার কাছে - তা বলে বোঝানো যাবে না। তিনি ছাড়া বাংলাদেশের শিল্পীদের ও আপামর মানুষের রবীন্দ্রনাথকে আপন করার আর কেই বা ছিলেন আমাদের কালে!
মনে পড়ে, কলকাতায় গিয়ে একবার এক ব্যাপারে মন খারাপ হওয়া নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া। টের পেয়ে বললেন, সন্ধ্যাবেলা তাঁর বাড়ির এক পারিবারিক সমাবেশে গান শুনতে আসি যেন। শান্তিনিকেতনের এক বাংলাদেশি ছাত্রী গান গাইবে। সুরের প্রলেপে এভাবে আমার মতো এক এলেবেলে যুবার মনোভূত ক্ষত দূর করতে চেয়েছেন তিনি। চাইবেনই তো কারণ সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি সঞ্চরণই তো করে গেছেন বছর নব্বইয়ের জীবনজুড়ে।
২০১৯-এ ঢাকার প্রথমা প্রকাশন শঙ্খ ঘোষের বাংলাদেশ বিষয়ক রচনার একটি সংকলন প্রস্তুতের অনুরোধ করলে, কাজে নেমে আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। কবিতা লিখেছেন কবি শামসুর রাহমানের জন্মতিথি, সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণ এমনকি কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের গৃহপ্রবেশ কেন্দ্র করে; তেমনি ভ্রমণকথায়, ভাবনাগাথায়, স্মৃতিরচনায় কতভাবে যে ভাস্বর তাঁর একান্ত বাংলাদেশ! একুশ, একাত্তর, নববর্ষ কি রবীন্দ্র-লড়াই - বাংলাদেশের মানুষের বাঙালিত্বের সাধনা, মনুষ্যত্বমুখী যেকোনো প্রবর্তনা তাঁর সজাগ-সংবেদী দৃষ্টি এড়ায়নি। সংকলনটির প্রাথমিক কাঠামো হাতে পেয়ে বন্ধু সন্দীপন চক্রবর্তী মারফত জানিয়েছেন আমার কাজে তাঁর বিস্ময়ের কথা। বিস্ময়ের সে বিভা যখন শঙ্খ ঘোষের লিখিত 'আত্মপ্রসঙ্গ'-এ পড়ি, আমারও তো বিস্ময়ের বাধ মানে না। লিখেছেন তিনি-
'ও পিয়াস? ঢাকার এই ছেলেটিকে তো চিনি আমি, সে করেছে এই নির্বাচন? এইরকমের এক অবিশ্বাসের বোধ থেকে শুরু করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে অবাক হয়ে ভাবি: এতটাই ভালোভাবে পড়েছে সে আমার লেখা? বিস্ময় চরমে পৌঁছয় যখন দেখি এমন লেখাও পিয়াস এর অন্তর্গত করেছে, যা আমার কোনো বইতেই নেই, এমনকি আমার স্মৃতি থেকেও লুপ্ত।'
'সন্ধ্যানদীর জলে' নামে বইটি বেরুল। ঢাকা-কলকাতায় সমান সমাদৃত হল। এর আগেও তো তাঁর কতক বই বেরিয়েছে ঢাকা থেকে কিন্তু এতটা আলোড়ন বোধ করি কমই হয়েছে। মাসুক হেলালের করা প্রচ্ছদটা এত পছন্দ হয়েছিল তাঁর, আমাকে বলেই ফেললেন, 'মনে হয়, প্রচ্ছদেই বয়ে চলেছে সন্ধ্যানদী।'
বাংলাদেশ তাঁর জন্মের মাটি, প্রাথমিক বিকাশ ও শিক্ষাশুরুর ভূমি। বাল্যবন্ধু একাত্তরের শহীদ আনোয়ার পাশার কবিতাবই 'নদী নিঃশেষিত হলে' উপহার দিয়েছিলাম একবার। হাতে নিয়ে যেন চাপা কান্নায় উচ্চারণ করলেন, 'আনোয়ার...'।
বাংলাদেশ, আনোয়ার পাশার মতোই লাখো শহীদের রক্তেভেজা দেশ। শঙ্খ ঘোষের নদীতর্পণে তো জলের ছলে মুহুর্মুহু কীর্তিত হয় সেইসব শহিদেরই শাশ্বত শ্বাস:
'আমার সম্বল শুধু ঝুমকোঘেরা মঠ অবিকল/
আমার নদীর নাম সন্ধ্যানদী, তুমি তার জল।'
Powered by Froala Editor