এইসময় একের পর এক মৃত্যুসংবাদ আমাদের চৈতন্যকে অসাড় করে দিয়ে যাচ্ছে। পিঞ্জিরায় বসে একটি মৃত্যুর শূন্যতা অনুভব করতে না করতেই আরেকজনের চলে যাওয়ার খবর হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে। তছনছ হয়ে যায় দিনযাপন। মৃত্যু আমাদের শোক মামুলি করে তুলেছে। হিটাইটের মুখের আদল মাঝে মাঝে কুঁচকে উঠছে আতঙ্কে। নরকে ছয় ঋতুর থেকেও কি অসহনীয় নয় এই ভয়াবহ পরবাস - এভাবে বেঁচে থাকা যায়; বাঁচা যায়?
কবি গৌতম বসু চলে গেলেন। তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা খুব বেশি হয়তো ছিল না। তাঁর পাঠকরা তাঁর রচনার মতনই নিভৃতচারী – হাট-বাজারের কোলাহল থেকে দূরে তাদের অবস্থান। কিন্তু কোনো অভিমান নেই সে জন্য। নেই কোনো অপ্রাপ্তির বঞ্চনাবোধ। আসল কথা হল কবিতা লেখা - মন ভরানো, স্নিগ্ধ কিছু উচ্চারণ…
একটি ছোটো দোকানে প্রায় বছর পঁচিশেক আগে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল' বইটি। ঘোর লেগেছিল। ভর হয়েছিল। রুশ কবিতার সামান্য চর্চা করি। রুশ কবিদের অনেকেই যেভাবে স্বদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করেছেন, তেমনই পরিক্রমণ এই বাঙালি কবির। গুহ্য শাস্ত্রের চর্যা।
দীর্ঘ কয়েকবছর বাদে, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের এক তরুণ অনুরাগীর কাছ থেকে ফোন নম্বর যোগাড় করে যোগাযোগ করি ওঁর সঙ্গে।
আরও পড়ুন
আপোস করেননি, যাওয়ার দিনেও জলই ‘প্রকৃত শ্মশানবন্ধু’ গৌতমের
‘কফি হাউসে বড্ড চিৎকার-চেঁচামেচি, ভালো করে কথাবার্তা বলা যায় না; বসন্ত কেবিনে বসলে কেমন হয়?’
আরও পড়ুন
প্রয়াত কবি গৌতম বসু, শোকস্তব্ধ পাঠকমহল
আমি রাজি। দেখা হল যথাসময়ে। পাজামা পাঞ্জাবি পরা সৌম্য শান্ত চেহারা। ওঁকে দিলাম আমার অনূদিত, ‘তারকোভস্কির কবিতা' - সানন্দে গ্রহণ করলেন। জানালেন, বাংলা কবিতার বাইরে আধুনিক রুশ কবিতার অনুসন্ধিৎসু পাঠক উনি। বিশেষত মান্দেলস্তামের রচনা ওঁকে মুগ্ধ করে। মান্দেলস্তামকে নিবেদন করে একটি কবিতাও ওঁর আছে। পড়েছি সেই কবিতা…
খানিকক্ষণ রুশ কবিতা নিয়ে আলোচনার পর বাংলা কবিতার কথা উঠল। আবহমানকালীন বাংলা কবিতা কি হারিয়ে যাবে? চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, ঈশ্বর গুপ্ত, লালন শাহ'র বাংলা কবিতার কি ইতি ঘটল জীবনানন্দ, আল মাহমুদে এসে? কমলকুমারের মত ‘আমাদের লুপ্ত পূজাবিধি’ কবিতায় কে, ভাবে-ভাষায় উদ্ধার করবেন? উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন ‘আমি সেভাবেই ভাবি।’
গৌতম আমাকে ওঁর কাব্যসমগ্ৰ উপহার দিয়েছিলেন একটি বইমেলায় - এত কৃশ যে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি, যে ষাটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছনো এক কবির কাব্যকৃতির আয়তন এমন কম হতে পারে। আবার নতুন করে মুগ্ধ হলাম - ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কবিতা পাঠের আনন্দ সমগ্ৰে ধরা দিল।
চাকরিসূত্রে উত্তরবঙ্গে বদলি হয়েছিলেন গৌতম - যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠল। একটি স্বল্পায়ু ওয়েবজিন সম্পাদনা করেছিলেন। আমায় পাঠিয়ে মতামত চেয়েছিলেন। সম্পাদনায় ওঁর পারদর্শিতার নমুনা ধরা আছে ‘গিলগামেশ কাব্যে’। এত সুললিত অনুবাদ ও ভাষ্যরচনা, ইদানিংকালে চোখে পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠক্রমের অন্তর্গত থাকায়, যা নীরস মনে হয়েছিল, তা ওঁর তর্জমা ও প্রেক্ষিত রচনার গুণে সজীব হয়ে উঠল।
বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম এক রূপকারের সীমাহীন অনুকম্পা ও তাচ্ছিল্য ছিল রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী বাঙালি কবিদের প্রতি। এও কি বাংলা কবিতার বিধিলিপি যে সাম্প্রতিকের কবিরা তাঁর থেকেই নিজেদের পথনির্দেশনা লাভ করে আত্মতৃপ্তভাবে কবিতা রচনা করছেন - লিখছেন ’পোস্ট গ্লোবালাইজেশন এরা'র নিরবলম্ব, ছিন্নমূল এক পদাবলি।
গৌতম থাকলে তাঁর কাছে দাবি জানাতে পারতাম। বাংলা ভাষায় লেখা তরুণ কবিদের রচনা পাঠ করতে করতে বাংলার খোঁজ করে যাই। তখন গৌতমের কথা মনে পড়ত। আর হয়তো মনে পড়বে। তখন আবার সাধ হবে কবির সঙ্গে বলতে, ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল'।
Powered by Froala Editor