সালটা ১৯৬১। সাসেক্সের বিরুদ্ধে ক্রিকেট ম্যাচ খেলে কয়েকজন বন্ধু খেতে গেছেন ইংল্যান্ডের একটি রেস্তোরাঁয়। ওঁদের মধ্যে ছিলেন এক ভারতীয় ছাত্রও। লম্বা, তীক্ষ্ণ রাজকীয় চেহারার ছেলেটি ব্যাট হাতে নামলে রীতিমতো শাসন করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক বলেও কথা! যাই হোক, রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সুস্থভাবেই সবাই গাড়িতে উঠেছিলেন। হঠাৎই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। গাড়িটির উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে একটি কাচের টুকরো ঢুকে যায় ভারতীয় ছেলেটির ডান চোখে। এক লহমায় চারিদিকে অন্ধকার। চারিদিকে রক্ত আর রক্ত…
সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বছর কুড়ির ছেলেটিকে। অপারেশনও করা হয়। কাচের টুকরোটাও বেরোল। কিন্তু ততক্ষণে সে নিজের কাজটুকু করে দিয়ে গেছে। চিরজীবনের মতো ডান চোখটি নষ্ট হয়ে গেল। সবার মাথায় হাত। বন্ধুরা হতাশ। এবার কী হবে? কেরিয়ার তো শেষ! হতাশ হলেন না একজনই— ওই ছেলেটি। মনসুর আলি খান পটৌডি। ডান চোখ গেছে তো কী হয়েছে! বাঁ চোখটি তো রয়েছে…
বন্ধুদের হতাশ হওয়ার কারণও আছে। ১৯৫৬ সাল থেকে মনসুর পটৌডি ইংল্যান্ডে স্কুল ক্রিকেট খেলছেন। শুধু নেতৃত্ব দেওয়াই নয়, মাঠে নামলে তাঁর ব্যাট যেন কথা বলত। দুরন্ত ফর্মে ছিলেন তিনি। এমন একজন প্রতিভার যদি এই বয়সেই একটি চোখ চলে যায়, তাহলে কী হবে? কিন্তু হার মানলেন না মনসুন আলি খান পটৌডি। নবাবের রক্ত বইছে তাঁর শরীরে। জন্মেছেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে। বাবা ইফতিকার আলি খান পটৌডিও ক্রিকেটার ছিলেন। ভারত এবং ইংল্যান্ড— দুই দলের হয়েই টেস্ট খেলেছেন। আর সেই খেলাতেই কিনা পিছিয়ে যাবেন মনসুর!
এর মধ্যেই শুরু হল আরেক সমস্যা। দুর্ঘটনার পর প্রথম নেট প্র্যাকটিসে নামলেন মনসুর। এ কি! সামনে যে দুটো বল দেখছেন! প্রথমত এক চোখে দিয়েই দেখতে হচ্ছে; উপরন্তু একটি বলের জায়গায় দেখছেন দু’দুটি বল। খেলবেন কী করে? সঙ্গে সঙ্গে নেট প্র্যাকটিসের সময় বাড়িয়ে দিলেন মনসুর। ঠিক চার মাসের মধ্যে বাইশ গজে ফিরে এলেন তিনি। এবং নেমেই ৫১ রান! ঠিক দুমাস পর ডাক পেলেন ভারতের জাতীয় দলেও। দিল্লিতে অভিষেক হল টাইগারের। টাইগার পটৌডি— আর কয়েক মাস পরেই যে নামে তাঁকে চিনবে গোটা বিশ্ব…
ষাটের দশকের শুরুতে সেই বিখ্যাত ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজ। তখনও এই দেশটি ‘দৈত্য’ হয়ে ওঠেনি। ইংল্যান্ডের দলে রয়েছেন কেন ব্যারিংটন, টেড ডেক্সটার, ডেভিড অ্যালেনের মতো ক্রিকেটাররা। ভারতীয় দলেও আছেন বিজয় মঞ্জরেকর, সালিম দুরানি, নরি কন্ট্রাক্টররা। সেখানেই অভিষেক হল ২০ বছরের মনসুর আলি খান পটৌডির। মনে করুন চেন্নাইয়ের (তখন মাদ্রাজ) তৃতীয় টেস্ট ম্যাচটির কথা। একে নবাগত, তার ওপর ডান হাতি খেলোয়াড়ের ডান চোখটি সম্পূর্ণ নষ্ট। যে চোখে দেখতে পান, সেই চোখে একটির বদলে দুটি বল ছুটে আসতে দেখেন। এত সব দুর্যোগ সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের কার্যত দাঁড় করিয়ে রাখলেন মনসুর আলি খান পটৌডি। করলেন মূল্যবান ১০৩ রান। এবং মনে রাখা দরকার, ওই টেস্ট সিরিজটি কিন্তু ভারতই জিতেছিল। এই প্রথমবার ইংল্যান্ডকে তাঁরা হারাল বাইশ গজের যুদ্ধে…
ধীরে ধীরে বদলটা যেন শুরু হচ্ছিল। ১৯৬২-র ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর। মনসুর আলি পটৌডি সহ-অধিনায়ক। বার্বাডোজের টেস্ট ম্যাচে অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর চোট পেয়ে বেরিয়ে গেলেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতীয় অধিনায়কের মসনদে বসলেন টাইগার পটৌডি। শুরু হল নতুন এক যুগ। পটৌডি যুগ। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম স্মরণীয় সময়। মনসুরের হাত ধরেই ১৯৬৮-তে নিউজিল্যান্ডকে ঘরের মাটিতে হারায় ভারত। বিদেশের মাটিতে ওটিই ছিল প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়। পটৌডির সাম্রাজ্য তখন মধ্যগগনে। যেমন ছকভাঙা ব্যাটিং, তেমনই অধিনায়কত্ব। পরবর্তীকালে যার সার্থক উত্তরসূরি কপিল দেব, আজহারউদ্দিন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা…
আরও পড়ুন
পরিবেশ-নিধন রুখতে আদানির বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড, সাক্ষী ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ
তবে এসবের বাইরেও গোটা ভারত এবং বিশ্ব ক্রিকেট মহলে পটৌডির প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব। শুধু অধিনায়ক হিসেবে নয়; ওই সময় তাঁর মতো দক্ষ ফিল্ডার খুব কমই ছিল। এক চোখ নিয়েই বিশ্বজয় করেছিলেন মনসুর। শুধুমাত্র তাঁকে দেখে পাড়ায় পাড়ায় সবাই এক চোখ বন্ধ করে ক্রিকেট খেলত। খেলার ইতিহাস বলে, পরবর্তীকালে আর বেশ কিছু ক্রিকেটারের চোখের সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু কেউই নিজের সেরা জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়ে বলতেন, পটৌডি এক চোখেই যদি এত কিছু করেন, তাহলে পুরোপুরি সুস্থ হলে আর কি কি করতেন! পরিসংখ্যানের বাইরেও এক বিরাট ক্রিকেটের জগত আছে। সেই জগতে মনসুর আলি খান পটৌডি সত্যিকারের নবাব। সত্যিকারের টাইগার। এক বিরল কিংবদন্তি…
তথ্যসূত্র –
১) ‘Mansur Ali Khan Pataudi obituary’, David Frith, The Guardian
২) ‘ক্রিকেটের নবাব!’, সৌরভ কুমার দাস, স্পোর্টস ভয়েস ২৪
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনার তিনি, বোর্ডের সঙ্গে সংঘাতে ছেড়েছিলেন ক্রিকেট