‘শিকল দেখে আবার মনে পড়ল শব্দের কথা / শিকল রূপান্তরিত জল, সব দর্শক যখন অতীত / তখনও অনেক ভূমিকা থেকে যাবে / এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।’
এই লেখা যখন লেখা হচ্ছে, তখন হয়তো জলের বুকেই ভেসে যাচ্ছে গৌতম বসুর অস্থিভস্ম। অতিমারীর সময়ে কজন শ্মশানবন্ধুই বা জড়ো হতে পেরেছেন তাঁকে বিদায় জানাতে? তাঁর কবিতার মতোই, তাঁর জীবনের মতোই, তাঁর চলে যাওয়াটুকুও বড়ো শান্ত, কোলাহলহীন। এবং সমস্ত শিকল ছাড়িয়ে এই চলে যাওয়ার দিনেও তাঁকে জড়িয়ে আছে জল। ‘প্রকৃত শ্মশানবন্ধু’। আর রামপ্রসাদ সেন? কবি গৌতম বসুর কবিতায় বারবার ঘনিয়ে আসা সেইসব অপ্রত্যাশিতরা? তারাও কি তাঁরই সঙ্গে ভেসে চলেছে?
যে-কোনো কবিরই নিজস্ব কিছু অসম্ভব থাকে। গৌতম বসুরও ছিল। আর ছিল জলের সম্পর্ক, বৃষ্টির সম্পর্ক। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’-র ‘বিশ্রামতলা’ কবিতায় ফিরে আসা বৃষ্টির মতোই নশ্বর। ‘তার কাছে বৃষ্টির মতো ফিরে আসি/ আমার দুইকূল তার চোখের কালি, জলভারে/ বেঁকে নীল হয়, জ্যোৎস্নায় আবার স্ফীত, উতলা হয়ে ওঠে;/ নক্ষত্রের নশ্বর দৃষ্টিপাত, নশ্বর আমার পদধূলি’। বৃষ্টির কথা বললে তাঁর কবিতারা ফুরোতে চাইবে না। এই অতি তুচ্ছ এক মানুষকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো, বৃষ্টি আমার কবিতায় অনেকবার এসেছে। বৃষ্টি তো অনেকবারই আসে।” আমি আজ সেই চিঠির সামনে বসে আছি। মনে হচ্ছে, এও কি কবিতা নয়? বৃষ্টি তো আজও এসেছে...
মানুষ গৌতম বসুকে আমি চিনেছি এই সেদিন। বছর দুই আগে। সে আলাপের শুরুতে একটা অকিঞ্চিতকর লেখা, যা আমায় দিয়ে একপ্রকার জোর করেই লিখিয়ে নিয়েছিলেন সোনালী চক্রবর্তী। আমার তখন টাইফয়েড। দৈনিক ও টানা জ্বর। তখন গৌতম বসুর কবিতা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। যে-কোনো লেখাই আমার কাছে অভিশাপের মতো। নিজের অক্ষমতাকে উপুড় করে দেব সবার সামনে, ভাবলেই নাকচ আর ভয় ঘিরে ধরে। কিন্তু সেই লেখা শাপে বর হয়েছিল। আমি ফিরে-ফিরে পড়েছিলাম 'রসাতল', ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ আর 'স্বর্ণগরুড়চূড়া’। পড়েছিলাম—
আরও পড়ুন
প্রয়াত কবি গৌতম বসু, শোকস্তব্ধ পাঠকমহল
‘কিছু ভয় বৃষ্টির রাতের জন্য সঞ্চিত থাকত
ঝড়ের যন্ত্র যখন অবিরাম প্রসবিনী, কিছু ভয় অনাথ;
শব্দও একপ্রকার অন্ধকার, যার উদ্দেশে কান পাতা রয়েছে
যার ভিতর, তমসা তাদের পথের কাঁটা, অহর্নিশ
জল বিতরণ করে, বৃক্ষের কুহক; আর এমন
নিদ্রার শোভা কেউ দেখেছে, কেউ দেখে নি
শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে, প্রথম রহস্য
অথবা সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা।’
আরও পড়ুন
কবিতা থেকে সিনেমা - সর্বত্রই নতুন ভাষা খুঁজেছেন বুদ্ধদেব
তারপর যাহোক করে একটা লেখা নেমেছিল। আর সেই লেখা পড়ে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন গৌতম বসু। লিখেছিলেন, “একদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা পরস্পরের অপরিচিত, আবার, অন্যদিক থেকে ভাবতে গেলে, পরিচয় অতিনিবিড়।” অতি নিবিড় পরিচয়ের অধিকারেই এরপর কথা এগোবে আরো খানিক। জিজ্ঞেস করবেন, “আপনার লেখায় আমার কবিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য নেই কেন? তা কি নেহাতই সৌজন্যবশত?” এর কোনো উত্তর দেওয়া হবে না আমার। আমি কোন আহাম্মক যে তাঁর কবিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করব? কবিতার আমি কী বুঝি! আমার হয় কবিতা ভালো লাগে, নাহলে ভালো লাগে না। কোনো কবিতা কেন ভালো লাগে, তাও আমি স্পষ্ট বুঝি না। আমার এই না-বোঝা গৌতমদা বুঝেছিলেন নিশ্চিত। তৃতীয় চিঠিতে সম্বোধন আপনি থেকে তুমি-তে থিতু হয়েছিল। তাঁর কবিতায় বৃষ্টির বাহুল্য নিয়ে প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, “সে একসময় ছিল।” একসময়? পরে আর নয়? তাহলে ‘জরাবর্গ’-র শুরুতেই লিখলেন কেন ‘সব প্রশ্ন থেকে ভীষণ প্রতিহত, ফিরে আসছিলাম / আমার গায়ে, প্রহরী, সেই ছায়া এসে পড়ল আবার, / যেন-বা কাঁধের এক পাশ মেঘের গর্জনে ভিজে গেছে।।’ এই মেঘের গর্জনের পরেই তো বৃষ্টি। যা গায়ে মেখে আমরাও কয়লার পাহাড় খুঁজি। আর দেখি শ্রাবণ পেরিয়েও বৃষ্টি থামে না।
আরও পড়ুন
স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করায় কবিকে নির্মম হত্যা মায়ানমারে
কবিদের অবশ্য কবিতা নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। করলে বিপদ বাড়ে। এই যেমন গৌতম বসুর একটা জনপ্রিয় কবিতা ‘শ্রাবণ’। গোটা কবিতাকেই জাপ্টে বিস্ফোরণ বা বজ্রপাতের অপেক্ষা, রসাতল, স্মৃতি আর ম্যাজিক।
‘এক ভীষণ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত বয়ে যায়। মেঘের পাতায়-পাতায় বৃষ্টি অস্থির, পায়ের নিচে গড়িয়ে চলে আকাশের জল; আমরা পারব কি নির্বিঘ্নে আরও একটি বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে? ক্ষয়ে-আসা, ভেঙে-পড়া আয়ুর প্রান্তে তপ্ত পাথরফলকের মতো এই দাঁড়িয়ে-থাকা, অদৃশ্য নতমুখ তাঁর, ধুয়ে যায়। ধুয়ে যায় আমাদের কথার ফাঁকে-ফাঁকে এতদিন পড়ে-থাকা দীর্ঘ বিরতিগুলি, নক্ষত্রগণনার কাজ। অকস্মাৎ, আরও একবার আলোর পর্বত মাথার উপর ভেঙে পড়ে; দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত হবার পর তিনি স্পর্শ করেন আমায়, দেখি, নিচে, বহু নিচে, ওই রসাতল। সুয্যি দত্ত লেনের দাবার রোয়াক থেকে আমি ডেকে উঠছি, ‘বিভূতিদা, বৃষ্টি আসছে!’ আঁচলের খুঁটে মাথা ঢেকে টুকুমাসি ছুটে-ছুটে ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে, রাজেনদের পায়রার ঝাঁক এক সাথে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে অজানা পৃথিবীর দিকে।’
বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কবিতার একটি ভৌতিক ব্যখ্যা দিয়েছিলেন গৌতম বসু। “ওপর থেকে ভূত হয়ে গিয়ে সে যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে। মরে ভূত হ’য়ে গেছে… নিচে বহু বহু দুরে তার পরিচিত পৃথিবীর দৃশ্য দেখে সমস্তই কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। আমি ভূত হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু আমার পাশে আরেক জন আছেন, যিনি ভূত নন, কিন্তু তার বিষয়ে আমি বিশেষ কিছু বলতে পারব না।” এমন ব্যাখ্যা কেন দিয়েছিলেন? তার উত্তরে এসেছিল সহাস্য প্রতিপ্রশ্ন “কেন কবিতার ভৌতিক ব্যাখ্যা হতে নেই?”
ভৌতিক নাকি অসম্ভব, জানি না। থাকা, না-থাকার ঔচিত্যবোধ নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতাও আমার নেই। আমি শুধু ভাবি, গৌতম বসুর কবিতা আবিষ্কার করতে আমার এত সময় লাগল কেন? কলেজজীবনের প্রথম দেড়বছরেও আমি তাঁর কবিতা পড়িনি। আমার মতো বাংলা কবিতার ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে গর্ব করা অনেক ছাত্রছাত্রীই তাঁর কবিতা পড়েছে অনেক পরে। অনেকে হয়তো আজো পড়েনি। কেন? তিনি প্রতিষ্ঠানের শিরোপা পাওয়া ‘জনপ্রিয়’ কবি নন বলে? তাঁর বই সহজলভ্য নয় বলে? কলেজস্ট্রিটে ঘুরে-ঘুরে তাঁর বই খুঁজে নিতে হয় বলে? কিন্তু কেন তিনি বিখ্যাত নন? তিনি কি বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন আদৌ? শুনেছি এই আপাদমস্তক ভদ্র, বিনয়ী, নরম কণ্ঠের মানুষটাকে নাকি অনেক বিখ্যাত কবিই ভয় পেতেন? কেন? কবিতা নিয়ে মানুষটা কোনোদিন আপোস করেননি বলে?
অতএব, গৌতম বসু কেন বড়ো কবি তা নিয়ে আমার কিছু বলা সাজে না। আমি তাঁর কবিতায় এই ফেলে আসা সময়ের ভাষাগন্ধ পাই। সেই গন্ধ ফেলে উঠতে পারি না। গৌতম বসুর কবিতা এক বাঁক থেকে অন্য বাঁকে যায়। রসাতলের পর নয়নপথগামী, স্বর্ণগরুড়চূড়া। বিসমিল্লার সুরে মিশে যায় বৈষ্ণব অনুষঙ্গ। অন্তর্ঘাতের মতো কিছু পঙ্ক্তি—
‘অখণ্ড একটি শোকদিবসের কিনারায়
গলায় শ্রীখোল প’রে দাঁড়িয়েছিলাম ব’লে
কেউ-কেউ তীব্র হেসে উঠেছিল, আমি জানি।
আমি জানি, ধুলোর মতন প’ড়ে থাকা যায়
কিন্তু ধুলো হয়ে-ওঠা ততটা সহজ নয়।
নীরব দৈত্যকুলের হে অবশেষ, প্রণাম!’
আমি তাঁর কবিতায় জন্মান্ধ এবাজুদ্দিন লস্করকে খুঁজে পাই। তাঁর মতো কবিও জন্মান্ধ। ‘বিপুল হাওয়ায় চুলদাড়ি উড়ছে, মাথা উঁচু; গোধূলিবেলায় সেই নিশ্চল মূর্তির সম্মুখে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থেকেছি, এক আলোকময় সিংহদ্বারের দুই জন্মান্ধ প্রহরী।’ একজন দৃষ্টিহীন, আরেকজন দৃষ্টি থাকতেও... কেউ কারো জন্মান্ধতার থই পান না। আর বেহুলা? ‘ঘুম ফুরিয়ে গেছে বেহুলার, ঘুম তবু শুয়ে রয়েছে তার কোলে, ঘুমের দুয়ারে আলো এসে পড়েছে।’ গৌতম বসুর কবিতায় বেহুলা কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্নাকে নদীর চড়ায় মরে যেতে দেখেনি। এখানে নদী আদিগন্ত। ‘সমুদ্রের মতো নদী, আকাশের মতো সমুদ্র, ব্রহ্মাণ্ডের মতো আকাশ।’ বেহুলাও নদীরই মতো আর তার কোলে চিরঘুমে তারই জীবন। নদীর পাড়ে বিগত যা-সব আছে, সেখানে ক্রমে আলো ফেলেন গৌতম-- ‘নদীর পাড়ে যে জীবন সে ফেলে এসেছে, তাকেও স্পর্শ করো রশ্মিসকল’, শব্দে বোনা দৃশ্যেরা তাঁর আজ্ঞাপালন করে।
আমি চাই, গৌতম বসুর কবিতার এই উপত্যকা নিজের মতো করে খুঁজে নিক আরো বেশি পাঠক। 'সৈকত' কবিতার শেষে হয়রতকে আবিষ্কার করুক চকিত বিস্ময়ে, ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’-এর ১০ সংখ্যক কবিতার শেষে চমকে উঠুক। ‘শ্রীরাধারক্রমবিকাশ’ বা ‘গল্প’-এর কবির পরিধিকে চিনুক। ‘রিসালা’ পড়ুক কিংবা ‘পটনার মতিচন্দ’। ‘যেভাবে সর্বপ্রথম নরকের সঙ্গে /দেখা হয়েছিল কুয়োতলায়, ফিরে এসেছে হাড় হিম-করা প্রতিধ্বনি’। ক্লান্ত দেবদূত এরপর শুনবেন ‘আঈলন হো রামজী অয়োধ্যা মেঁ’। আর পাঠক থই পাবে না কিছুতেই। কবিতা কি বোঝার জিনিস? আমার মতো অযোগ্য পাঠকরা তাহলে ঠাঁই পাবে কোথায়?
গৌতমদা আমাকে দেওয়া শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন, “কেউ আমার কবিতা খুঁজে খুঁজে পড়লে ভালো লাগে। সেই ভালো লাগা কবিতা লিখে পাওয়া তৃপ্তির মতোই।” সেই তৃপ্তি আমরা তাঁকে কতটুকুই বা দিতে পারলাম? তিনি চাইলেনই বা কতটুকু? আজ যখন এইসব শব্দ, বিষাদ, ছেনাল পৃথিবীর সব সুতো ছাড়িয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন, তখনও দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বৃষ্টি। আকাশ ফেটে জল নামছে। আর আমি ‘আখতারী বাঈ’ কবিতাটা খুঁজছি। তোলপাড় করে। এত অযত্নে রাখি সব, এমনকি স্মৃতিকেও, যে সহজে কিছুই মেলে না। গৌতম বসুকেও বড়ো অযত্নে পেয়েছিলাম আমরা। বড়ো অযত্নে...
‘শেষ বাক্যে পৌঁছবার আগেই আপনি কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলেন,
আপনি জানেন, পশ্চাতে কেউ আছেন রুদ্ধ সুর কুড়িয়ে নেবার;
আর তখন, সুন্দর, ত্রিভুবনে অতুল হাহারব ছড়িয়ে পড়ে।
যা-কিছু বলতে পারি নি, তা যেন কত শত রূপে ব’লে রাখলাম
যা-কিছু ব’লে রেখেছি, আশা জাগে, রাতের প্যাঁচারা দ্রুত নেমে এসে
সেইসব অতিতুচ্ছ তপ্তদেহ উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবে পবনে।
যা-কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায়
যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।’
Powered by Froala Editor