দ্বিতীয় পর্ব
স্যার ক্রিকেটের খুব ভক্ত ছিলেন। টনি গ্রেগের অধিনায়কত্বে ১৯৭৬-৭৭ সিরিজে ইংল্যান্ড এল ভারত সফরে। ইডেনে ভারত হেরে গেল বিশ্রী ভাবে। ভারতের অধিনায়ক তখন বিষেণ সিং বেদি। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রায় শেষ, সরস্বতী পুজো হয়ে গেছে, আমরা তখন ক্লাস টেনে। ব্যাঙ্গালোরে চতুর্থ টেস্ট চলছে। এখনও মনে আছে, স্যার এলেন ক্লাসে।চেহারায় টেনশনের ছাপ। আসলে মন পড়ে যে টিচার্স রুমের রেডিওতে। প্রিয় ব্যাটসম্যান গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ তখন ক্রিজে যে। হঠাৎ পড়াতে পড়াতে বলে উঠলেন – “এই যা তো কেউ। টিচার্স রুম থেকে বিশ্বনাথের স্কোর টা জেনে আয় তো।”
সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বন্ধু রাজা বলল, স্যার আমি যাব স্কোর জানতে।আসলে রাজার এই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যাওয়ার কথা বলা কেবল স্যারের সঙ্গে মস্করা করার উদ্দেশ্যে। অনেকবারই মার খেয়েছে স্যারের হাতে। ওদিন টিচার্স রুম থেকে রাজা ফিরে এসে জানাল, স্যার, বিশ্বনাথ আউট। এই কথা শুনে স্যার প্রায় রেগেমেগে ক্লাস থেকে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন। তারপর টিচার্স রুমে গিয়ে জানতে পারলেন, বিশ্বনাথ ব্যাটিং করছেন দাপটের সঙ্গে। মনে আছে,বিশ্বনাথ সেবার ৭৯ রান করেছিলেন। এই মস্করার অভিঘাত হিসেবে রাজার কপালে কী জুটেছিল তা তো সহজেই অনুমেয়। আনন্দের কথা, ভারত সেই ম্যাচে জিতেছিল। খুব সম্ভবত ১৪০ রানের ব্যবধানে।
স্মৃতিপথ ধরে কখনও কখনও একা হাঁটা বুঝি একটু কঠিন হয়। জীবনের দীর্ঘ সময় পরে অনেক মুহূর্তই সহজে স্মৃতিকোষ থেকে বেরোতে চায় না। সেখানেই তখন প্রয়োজন হয় পথসঙ্গীর। এখানে আমার সেই হাঁটার সঙ্গী হোক আমার বন্ধু গৌতম। ওর স্মৃতিতে আরও অনেক বেশি উজ্জ্বল সেই সত্তর দশকের দিনগুলো।
প্রথম পর্ব পড়ুন
১৯৭৭ সাল। আমরা ক্লাস টেনে উঠলাম।
গৌতম আর আমার বাড়ির ঠিকানা একই রাস্তার – জয়নুদ্দিন মিস্ত্রি লেন। মাঝখানে নদীর মতো চলে যাওয়া গোবিন্দ আঢ্য রোড। রাস্তার এই নামটা চারমাথার মোড়ে এক বাড়ির দেওয়ালে নীল বোর্ডের ওপর সাদা হরফে লেখা ছিল, তখনকার দিনে বলা হত কলাইয়ের বোর্ড, সে বোর্ড হত খুব মসৃণ। স্কুল যাওয়ার সময় রোজ না হলেও, বেশিরভাগ দিনই আমরা একসঙ্গে যেতাম। দিনেশবাবু থাকতেন চেতলার একেবারে শেষ সীমায়। গোপালনগর মোড়ে যেখানে লাল রঙয়ের সার্ভে বিল্ডিং, তার পাশে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই-এর বিরাট জেনারেটর বাড়ি। ঠিক তার উল্টোদিকে আফতাব মস্ক লেনে ছিল স্যারের বাড়ি।
ওখান থেকে স্যার রোজ হেঁটে আসতেন আমাদের স্কুলে। আমাদের স্কুলের কাছাকাছি আর একটা স্কুল আছে, কৈলাস বিদ্যামন্দির। আমরা একদিক দিয়ে যেতাম আর উল্টোদিকের রাখালদাস আঢ্য রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কৈলাস স্কুলের গা দিয়ে বাঁক নিতেন দিনেশবাবু। হাতে থাকত একটা ছাতা। বাঁকানো বাঁশের হাতলওয়ালা ছাতা। স্যারকে আমরা যখন পেয়েছি তখন উনি প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে গিয়েছেন, তাই চলাফেরায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন না তেমন। সেই চলা এখনও আমাদের চোখে ভাসে। লম্বা চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
আমাদের পাঠ সংকলনে একটা কবিতা ছিল কাশীরাম দাস রচিত মহাভারতের অংশ। সংকলক সেটার নাম দিয়েছিলেন ‘দুর্যোধনের প্রতি ধৃতরাষ্ট্র’। এটা ক্লাস টেনের সিলেবাসে ছিল। উনি একদিন পড়াচ্ছেন কবিতাটা। একটা কথা ছিল ‘তেঁই প্রভু’। এই ‘তেঁই’ শব্দটার অর্থ গৌতম স্যারের কাছে জানতে চাইল। স্যার তখন ওই কাব্যের রসে পুরোপুরি ডুবে গেছেন। এদিকে মাঝপথে অর্থ জানতে চাওয়ায় ছন্দপতন, তাই স্যার বেশ রেগে গেলেন।
তখন আমাদের ক্লাসরুম ছিল, চেতলা স্কুলের মেন গেট দিয়ে ঢুকে একেবারে সোজা তাকালে যে দোতলা দেখা যায়, সেখানে। মাঠ থেকে একটা লম্বা সিঁড়ি সোজা উঠে যেত, সেখানে বামদিকের প্রথম ঘরটা ছিল আমাদের ক্লাস, তার সামনে একটা রেলিং দেওয়া বারান্দা। ব্ল্যাকবোর্ড লাগোয়া একটা বিশাল চৌকি ছিল। আমাদের স্যারেরা চেয়ারে বসতেন। সেখান থেকে নেমে এসে স্যার গৌতমকে মারতে উদ্যত হলেন।গৌতম কোনোরকমে নিজেকে সেই মারের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
স্যার শেষকালে আর কিছু না করে আবার চেয়ারের কাছে গিয়ে বললেন – “দিলি তো আমার মেজাজ খারাপ করে। তোরা কী ভাবিস? আমি এই স্কুলে পড়াই বলে আমার কোনও দাম নেই? তবে শোন তোরা।” এই বলে হাল্কা বিস্কুট রঙের খদ্দরেরপাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে বললেন –“এই চিঠি আমাকে ত্রিপুরা সরকার পাঠিয়েছে, ওদের ওখানে সম্বর্ধনা সভায় আমি আমন্ত্রিত অতিথি। এর সঙ্গে যাতায়াতের বিমানের টিকিটও এসেছে।”শেষে বললেন – “আমিএই কথাটার মানে তোদের এমনিই বুঝিয়ে দিতাম। এভাবে তোরা আমার মেজাজ খারাপ করে দিলি।”
সেদিনের মতো ক্লাস আর হয়নি। কারণ তারপরেই ঘণ্টা পড়ে গিয়েছিল। পরে গৌতম, স্যারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। মনে হয়, স্যার অন্যরকম কিছু ভেবেছিলেন গৌতমের ওই প্রশ্ন করায়। তাই হয়তো এতটা রেগে গিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে,কোনও কারণে অন্য কোনও শারীরিক বা মানসিক অসুবিধা ছিল, যেটা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি।
১৯৭৮ সালে আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম। গৌতম আমাদের ব্যাচের টপার হল, সে আমাদের স্কুল থেকে চলে গেল পাঠভবন স্কুলে। সেই ছোট বয়স থেকে একসঙ্গে পড়ে আসা দুজন আলাদা হয়ে পড়লাম। আমি চেতলা বয়েজেই রয়ে গেলাম।ক’দিন আগেই পাঠভবনের নবীন বরণের স্মৃতিচারণা করছিল গৌতম। এখানেও জড়িয়ে ওই মানুষটি, যিনি আজকের মূল চরিত্র।গৌতম পাড়ি দেয় পাঠভবন স্কুলের সেই জায়গাটায়, যেখানে ১৯৭৮ সালে নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কলকাতার কোনও নামকরা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে আসা কলা বিভাগের কোনও এক ছাত্রের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল –
“বেয়নেট হোক যত ধারালো –
কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু!
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিয়ো, বন্ধু।”
কেমন অদ্ভুত লাগে ভাবতে। যে চাঁদ আজীবন কাব্যে ভালোবাসা কিংবা অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে থাকল, সেই চাঁদের দুই রূপকে বাংলার প্রায় সমসাময়িক দুই সাম্যবাদী কবি মেহনতি মানুষের সম্পদ করে তুলছেন। দিনেশ দাস অর্ধচন্দ্রকে কৃষকের কাস্তে মনে করছেন, কিছু পরে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাবনায় পূর্ণচন্দ্র হয়ে উঠছে পোড়া রুটি। এখানেই বুঝি কবিতার অমরত্ব।
‘কাস্তে’ কবিতা লেখা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। একবছর সে কবিতা ব্রিটিশের রোষের ভয়ে ছাপা বন্ধ ছিল। সেই একবছর দিনেশ দাস কোনও কবিতা লেখেননি অভিমানে। ১৯৩৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন সহ-সম্পাদক কবি অরুণ মিত্রের তৎপরতায় সেই কবিতা ছাপা হল। ছাপার পরে তাঁর কবিতার বিখ্যাত লাইন ‘এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’-র জনপ্রিয়তা যে স্তরে পৌঁছেছিল, একই লাইন ব্যবহার করে অন্যান্য নামকরা কবিদের কবিতা রচনায় সেই জনপ্রিয়তা সুস্পষ্ট।
কবি বিষ্ণু দে লিখলেন –
“আকাশে উঠল ওকি কাস্তে না চাঁদ
এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে!
জুঁইবেলে ঢেকে দাও ঘন অবসাদ,
চলো সখি আলো করে ভাঙা নেড়া ছাদ।”
আবার কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় একটু অন্যরকম সুরে বেজে উঠছে এই লাইন –
“আকাশে উঠেছে কাস্তের মতো চাঁদ
এ-যুগের চাঁদ কাস্তে।
ছায়াপথে কোন অশরীরী উন্মাদ
লুকাল আসতে আসতে।”
ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ও এই উদ্ধৃতিকে শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করলেন একটি ছোটগল্পে। অর্থাৎ, দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কেবল এক যুগের ভাঙাগড়ার প্রতিচ্ছবি নয়, তা বাংলা সাহিত্যে এক ঘটনা। এসব কথা ভাবলে কেবলই মনে হয়, কী অমূল্য এক সান্নিধ্য আমরা লাভ করেছিলাম, সাতের দশক জোড়া আমাদের চেতলার স্কুলজীবন কী অসামান্য সৌভাগ্যের ভাগী করেছিল আমাদের। আমরা দিনেশ দাসকে পেয়েছিলাম।
গৌতম বলে চলে, তার স্মৃতিতে এখনও টাটকা সে অনুভূতি। সে অনুভূতি গর্বের, এক অপার মানসিক শান্তির। সেদিন পাঠভবন স্কুলের নবীন-বরণ অনুষ্ঠান শেষে তার ওই নতুন বন্ধুকে ডেকে গৌতম প্রশ্ন করে – “তুমি যে কবিতা পাঠ করলে, তার কবিকে চেনো? ওই কবির ছাত্র আমি। কবি দিনেশ দাস যে স্কুলে পড়ান, সেই চেতলা বয়েজ স্কুল থেকে আমি এসেছি।” চেতলা বয়েজ স্কুল নাম শুনে অনেকেই একটু অবাক হয়। তারা প্রথমে ভেবেছিল, কী আর এমন স্কুল ওই চেতলা বয়েজ? কিন্তু কবি দিনেশ দাস যেখানে বাংলা পড়ান, সে স্কুল নিয়ে গর্ব করার যথেষ্ট করার কারণ আছে। আমার বন্ধু গৌতম এভাবেই নতুন স্কুলের নতুন বন্ধুদের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিয়েছিল সেদিন।
১৯৭৮ সালে স্কুলে স্যার আর নেই। তখন উনি অবসর নিয়ে নিয়েছেন। এমন হতে পারে, ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের টেস্ট পরীক্ষার পর আমরা যখন রোজকার স্কুল থেকে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন, তখনই হয়তো স্যার অবসর নিয়েছিলেন। তাই তাঁর বিদায় সম্বর্ধনাতে আমাদের থাকা হয়ে ওঠেনি।
এই স্মৃতিকথায় আরও এক বন্ধুর কথা না বললেই নয়। সে শৈবাল, শৈবাল মুখোপাধ্যায়। শৈবাল আমাদের সঙ্গে একেবারে প্রাইমারি থেকেই পড়েছে। কিন্তু ও আমাদের স্কুল ছেড়ে চলে গিয়েছিল ক্লাস এইটের পরেই। বারুইপুরের খাসমল্লিকে কোনও একটা স্কুলে ভর্তি হয়।তখনকার দিনে বারুইপুর মানে কলকাতার চেতলা থেকে অনেক দূর। খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। গৌতমেরও একই অবস্থা। তখনকার দিনে চিঠি লেখার চল ছিল খুব। তাই আমার আর শৈবালের মধ্যে চিঠি আদানপ্রদান হত। বারুইপুর চলে গেলেও চেতলার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শৈবালের। নিয়মিত কবিতা চর্চা করত দিনেশ বাবুর কাছে। আমাকে বলত, ওঁর কাছে কবিতা লেখা শিখছে।
এই সেদিন আমার আর গৌতমের ফোনালাপে আরও একটা নতুন তথ্য বেরিয়ে এল। একবার ওদের দুজনের ইচ্ছে হল স্যারের একটা ইন্টারভিউ নেবার। তাই শৈবালের সঙ্গে গৌতমও দিনেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল। সেই সময় স্যার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বলেছিলেন – “আমি যে পরিবেশে থাকি সেখানে দিনের আলো ফোটার আগেই শুরু হয়ে যায় জলের লাইনে জল পাওয়ার জন্য বিবাদ, মাঝে মাঝে সেটা চরম অবস্থায় চলে যায়। চারদিকের শুধু কোলাহল। এভাবেই আমার কবিতা চর্চা চলে।”
এখান থেকেই বোধহয় ঝড়প্রেমী, ছন্দপ্রেমী কবির মনে জন্ম নেয় –
“মানুষ এবং কুত্তাতে
আজ সকালে অন্ন চাটি একসাথে
আজকে মহাদুর্দিনে
আমরা বৃথা খাদ্য খুঁজি ডাস্টবিনে” (কবিতা – ডাস্টবিন)
আবার এই কবিই লিখছেন-
“ঝাঁকে ঝাঁকে ঘরে ফেরা পানকৌড়ির সারি ধূসর পালকে
থোবা থোবা অন্ধকার ব’য়ে ব’য়ে নিয়ে এল
মুছে দিয়ে শেষ সোনা-রোদ
উদাস করুণ স্বরে ধুয়ে দিল পৃথিবীর সকল বিরোধ
প্রাণের প্রতিমা গড়ে অদেহী আকাশ হতে
বিলুপ্তির লোকে।
এখানে কাঁটায় গুল্মে কাঁপে প্রাণ কানায় কানায়
আকাশ সময় যেন একমুঠো আগুনে জোনাকি
প্রহরে প্রহরে তবু ডাক দেয় বাজবৌরী পাখি
অনন্ত কালের কানে মিছিমিছি সময় জানায়।” (কবিতা –‘দেউলপুর’)
এই কবিতার মধ্যে অপার প্রাকৃতিক বর্ণনার মাঝেও রয়ে যাওয়া যে জীবনবোধ,তা যেন তাঁর আজীবন মানব-সচেতন এক ভাবনারই চিহ্ন রেখে যায়। প্রকৃতিপ্রেম আর সাধারণ মানুষের কথা কোনোভাবে আলাদা নয়, কবিতা-যাপনে তিনি বারবার সেই ধারণাই দিয়ে গিয়েছিলেন।
যুবা বয়সে অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন, পরবর্তীকালে মার্ক্সের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন। কী জানি, প্রকৃতি থেকে মানুষকে আলাদা করে না দেখার এই চিরকালীন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো মার্ক্সের থেকেই পাওয়া। একইসঙ্গে, অসাধারণ ছন্দমাধুর্যের যে শিল্পবোধ, তাকেও কোথাও নষ্ট হতে দেননি তিনি।
আবার তাঁর কলম থেকে একদিন বেরিয়ে এসেছিল ‘রাম গেছে বনবাসে’, তা আবার গদ্যকবিতা। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮২ সালে উনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ ভূষিত হয়েছিলেন। তার বছর তিনেকের মাথাতেই উনি চলে যান। শরীর অনেককাল আগে থেকেই চলার পথে সমস্যা তৈরি করেছিল। আর সেই কারণেই হয়তো সেই আক্ষেপ কাব্যের ভাষা হয়ে বেরিয়ে আসে এই ভাবে –
“রাম গেছে বনবাসে
বৃদ্ধ দশরথ একা, একা শুয়ে আছে-
ওপর নীচেতে তার শুধুই শূন্যতা।
ছেলের বালিশখানি মাথার নীচোয় দিয়ে
চুপচাপ শুয়ে থাকেঃ
গহন নিশুতি রাতে তার সাথে বালিশ কি কথা কয়?
হয়তো সে-সব কথা সারারাত্রি শোনে বৃদ্ধ পিতা,
কখনো বা হামাগুড়ি দিয়ে চলে হৃদয়ের দিকে।”
আর শেষ দিকের লাইনে উঠে আসে –
“ছেলেরা হারিয়ে গেছে গাছ হয়ে বনের হৃদয়ে ।
সকলের মনে হয়,তারাও হারিয়ে গেছে –
সবাই চেঁচিয়ে ওঠে,
আমরাও গাছ হব, আমরাও গাছ হব”
কবিপুত্র শ্রদ্ধেয় শান্তনু দাস মহাশয় এক জায়গায় লিখছেন – “তাঁর শেষ গ্রন্থ ‘রাম গেছে বনবাসে’ (১৯৮২) রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়। মাননীয় রাজ্যপাল ভৈরব দত্ত পাণ্ডের হাত থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন। ‘রাম গেছে বনবাসে’ সম্পর্কে অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য ‘কবি ও কবিতায়’ লিখেছেন , “কবি নিজের বুকের ব্যাথাকে ভাষা দিয়েছেন মহাকাব্যের রূপকল্পের প্রতীকে। এই হৃদয়ের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে চলার বাগভঙ্গিতে বৃদ্ধ পিতা সন্তান-বিচ্ছেদে হামাগুড়ি দেওয়া পিতা হয়ে উঠেছেন। সন্তানের সঙ্গে একাত্মভাবেই কবিতাটি হৃদয়স্পর্শী হয়েছে।”
আবার একবার ফিরি পুরোনো কথায়। সেদিনের সেই সাক্ষাৎকার গৌতমের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। ও বলে চলে – “স্যার আমাদের সেদিন এই ‘রাম গেছে বনবাসে’ কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। আর সেদিন মনে হয়েছিল এ যেন তাঁর অন্তরের এক করুণ আকুতি। কোথাও যেন সব যেন বেরিয়ে এসে অসীমে ডানা মেলতে চাইছে। এখনও যখন এই কবিতাটা পড়ি চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্যারের সেই ঘর, সেই চেহারা। উনি তাঁর কণ্ঠে কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন। আর আমরা যেন অপুর মতো অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ওঁর মুখের দিকে।”
দিনেশবাবু চলে গেছেন, ৩৬ বছর হয়ে এল। চেতলা স্কুল সংলগ্ন রাস্তাটার নাম এখন আর ‘চেতলা রোড’ নেই, ওটা ‘দিনেশ দাস সরণি’। নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের মধ্যে এভাবেই হয়তো প্রতিদিনের যাওয়া-আসায় বেঁচে থাকেন স্যার। আমাদের সৌভাগ্য, তাঁর চাকরিজীবনের শেষ দুটি বছর আমাদের পড়িয়েছিলেন স্যার। আয় গৌতম, আয় শৈবাল, আবারও হাঁটি ওই সরণিটা ধরে। যতীন দাস সেতু দেখতে পাওয়ার দিনগুলো আলো দিক। মোহিতলালের কবিতায় ডুব দিন স্যার। রাজা আবার স্কোর জেনে এসে মিথ্যে বলুক। ব্যাখ্যা লেখাতে লেখাতে ষাটোর্ধ্ব স্যার আবার ছাতা নিয়ে ছুটে যান ওর পিছনে…
তথ্যঋণ –
শান্তনু দাস। “ভূমিকা”। দিনেশ দাসের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিকেশন, জুন ২০১৪ সংস্করণ।
আহমদ রফিক। “চাঁদ-কাস্তে ও কাস্তের কবিতা, গান”। কালি ও কলম, প্রকাশিত ৯ মার্চ ২০২০।
Powered by Froala Editor