গতবছরের জানুয়ারি মাস। লিবিয়ায় তখন জাতিপুঞ্জ সমর্থিত গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ডের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে লিবিয়ান ন্যশনাল আর্মির। ঠিক সেই সময় কসর বিন ঘাসির শহরে একটি ছোট্ট দোকানে হানা দিল একদল সৈনিক। দোকানদার এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের চোখ বেঁধে হাত মুড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হল গাড়িতে। তারপর চোখ খোলা হল এক প্রত্যন্ত গ্রামে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন একটি বাড়িতে। তাঁরা দেখলেন, সঙ্গে রয়েছে আরও বেশ কয়েকজন বন্দি। সেই দোকানদার ও তাঁর পরিবার বেঁচে ফিরতে পারলেও তাঁদের সামনে গুলি করে মারা হয় ৬ জন বন্দিকে। কিন্তু রহস্যের তো সেই শুরু। সবচেয়ে রহস্যময় বিষয় হল, সৈনিকরা সকলেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন রুশ ভাষায়।
সংবাদ সংস্থা বিবিসির সূত্রে উঠে এসেছিল সেই খবর। আর তারপর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তবে কি লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সমর্থনে যুদ্ধ করছে রাশিয়াও? রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনো রুশ সৈনিক যদি লিবিয়ায় থেকে থাকে, তবে তার সঙ্গে রাশিয়ার সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এই উত্তর থেকেই দানা বাঁধে সন্দেহ। উঠে আসে ওয়েগনারের কথাও। ইতিমধ্যে কানাঘুষো শোনা গিয়েছে রাশিয়ার এই গোপন সেনাবাহিনীর কথা। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের যুদ্ধেও নাকি অংশ নিয়েছিল তারা। আর তার পর থেকে পৃথিবীর নানা দেশেই যুদ্ধ করেছে তারা। তবে সন্দেহ থাকলেও জোরদার কোনো প্রমাণ ছিল না। সম্প্রতি সেই প্রমাণটিও উঠে এসেছে। আর এসেছে সেই বিবিসির দৌলতেই।
কয়েকমাস আগে লন্ডনে বিবিসির এক সাংবাদিকের কাছে ফোন আসে লিবিয়ার একটি সূত্র থেকে। ফোনে জানানো হয়, কসর বিন ঘাসির শহরে পাওয়া গিয়েছে একটি পরিত্যক্ত স্যামসাং ট্যাবলেট। এভাবে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র এসে পৌঁছবে, সেটা কল্পনাও করেননি কেউ। আবার এমনও হতে পারে, ট্যাবলেটটির সঙ্গে হয়তো যুদ্ধের কোনো যোগাযোগই নেই। খানিকটা সন্দেহ নিয়েই লিবিয়া পৌঁছায় সাংবাদিকদের একটি দল। তারপর ট্যাবলেটটি লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয় পরীক্ষার জন্য। আর সেটি হাতে নিতেই অবাক হয়ে যান ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। আপাতভাবে অবশ্য সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি প্রথমে। ট্যাবলেটটির সিকিওরিটি কোডও খুব সহজেই খুলে ফেলা গিয়েছে। মেমোরিতে রয়েছে একটি গেম অফ থ্রোনস এবং একটি মেইন ক্যাম্ফের ই-বুক। তবে অবাক লাগে ম্যাপস নামক অ্যাপ্লকেশনটিতে ঢুকতেই। সেখানে লিবিয়ার মানচিত্রজুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা লাল-নীল বিন্দু। কী অর্থ এই বিন্দুগুলির?
ওয়েগনার নিয়ে আগে থেকেই কিছু জানাবোঝা থাকায় অর্থ উদ্ধার করতে সময় লাগেনি বিবিসির সাংবাদিকদের। আসলে নীল বিন্দুগুলি হল শত্রুপক্ষের, অর্থাৎ জিএনএ সমর্থিত সৈনিকদের ঘাঁটি। আর লাল বিন্দুগুলিতে রয়েছেন ওয়েগনারের সদস্যরা। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লাল বিন্দু রয়েছে কসর বিন ঘাসির শহরকে ঘিরেই। যেটা ওয়েগনারের ঘাঁটি বলে সন্দেহ করা হয়েছিল আগেই। এরপর একে একে সেই বিন্দুগুলি নিয়ে খোঁজখবর চালাতে চালাতে উঠে আসে একজনের পরিচয়ও। যদি বাকি সদস্যদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনানী ভালুক, ধরিয়ে দিয়েছিল গুপ্তচরকেও!
বিবিসি সূত্রে জানানো হয়েছে, ইতিপূর্বে তাঁরা ওয়েগনারের দুজন সৈনিকের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পেরেছেন। এটি যে সরাসরি রাশিয়া সরকারের কোনো সেনাবাহিনী নয়, সেটা স্বীকার করেছেন তাঁরাও। অন্যদিকে রাশিয়ার আইন অনুযায়ী এই ধরণের যে কোনো বেসরকারি সেনাবাহিনী আসলে বে-আইনি। কিন্তু তাতে কী হবে, ওয়েগনারের প্রত্যেক সদস্যও যে এক একজন দাগী আসামী। সরকারি সেনাবাহিনীতে তাই তাঁদের এমনিই জায়গা হবে না। আবার বেকারত্বে জর্জরিত রাশিয়ায় অন্য কোনো সম্মানজনক কাজ খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। তবে সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরাসরি ওয়েগনারের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। বরং মধ্য এশিয়ায় তেলের খনির জন্য শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করা হয় তাঁদের। এভাবেই ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন গোপন এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তখন আর বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তা থাকে না।
আরও পড়ুন
ছেড়ে গেছে অধিকাংশ মানুষ, মৃত্যুর অপেক্ষায় রাশিয়ার এই শহর
কিন্তু চমক এখানেই শেষ নয়। এতদূর পর্যন্তও কোথাও সরাসরি রাশিয়ার সরকার জড়িত নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে আরেকটি বিষয়কে ঘিরে। তা হল, কসর বিন ঘাসির শহরে একটি মুদিখানার দোকানের বিল জমা করা হয়েছে খোদ রুশ দূতাবাস থেকে। তাহলে? কাদের জন্য গিয়েছে সেই রেশন? রাশিয়া সরকারই বা কেন তার খরচ বহন করেছে? কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দেয়নি রুশ দূতাবাস। সরকারও নীরব। ওয়েগনারের সঙ্গে কি সত্যিই যোগাযোগ নেই রাশিয়া সরকারের? নাকি সবটাই আসলে একটা গোপন জাল, যার মধ্যে ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েছেন কাজের সন্ধানে ঘুরতে থাকা কিছু যুবক!
আরও পড়ুন
সেনাবাহিনীর আক্রমণে বাস্তুচ্যুত ১ লাখ, গণমৃত্যুর প্রহর গুনছে মায়ানমার
Powered by Froala Editor