মাথার উপরে গনগনে সূর্য, নিচে তপ্ত বালিরাশি। তার উপরেই বেসবল খেলছে একদল লোক। যা কিনা কিউবার (Cuba) জাতীয় খেলা। কেউ কথা বলছে স্প্যানিশে, কেউ বা আরবি ভাষায়। দূরে যে স্কুলটা দেখা যাচ্ছে তার নাম সিমোন বলিভিয়ার স্কুল। যিনি ছিলেন কলম্বিয়ার মানুষ, উনিশ শতকে স্প্যানিশ উপনিবেশের লড়ে স্বাধীন করেছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার বহু দেশকে। রাস্তায় আঁকা রয়েছে চে গেভারার ছবি। অথচ, দেশটার নাম কিউবা নয়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কোথাও পাওয়া যাবে এই স্থানের সন্ধান। তাহলে চারপাশের বালি, নীল আকাশ আর সূর্যের তেজের সাহারা মরুভূমির মাঝখানে কীভাবে গড়ে উঠল একটা ছোট্ট কিউবা?
তার খোঁজে যেতে হবে আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম প্রান্তে। দেশটির নাম সারাউই আরব ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক। সারাউই (Sahrawi) গোষ্ঠীর মানুষদের ঠিকানা এখানে। ‘দেশ’ বলা হয়তো পুরোপুরি ঠিক হবে না, কারণ আজও মেলেনি ইউনাইটেড নেশনের সব দেশের স্বীকৃতি। জন্ম হয় সাতের দশকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ স্প্যানিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর। যদিও আসল লড়াই শুরু তারপর থেকে। পার্শ্ববর্তী দেশ মরক্কোর আধিপত্য থেকে ‘স্বাধীনতা’-র জন্য তারা তৈরি করে ‘পোলিসারিও ফ্রন্ট’ (Polisario Front)। চলতে থাকে গেরিলা যুদ্ধ। আর তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় কিউবা। যুদ্ধের তাণ্ডবে বহু মানুষ পালিয়েছেন আলজেরিয়াতে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন রিফিউজি ক্যাম্পে। আপাতত সেই ক্যাম্পগুলোর ভরসাতেই চলছে একটা দেশ।
১৯৭৫-এ যুদ্ধ শুরুর পর কিউবা দীর্ঘদিন ধরে সাহায্য করেছে অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাঠিয়ে। কিউবার রাজধানী হাভানা থেকে ৪৫৮০ মাইল দূরে পাড়ি দিয়েছেন বহু চিকিৎসক আর শিক্ষক। এখনও রয়েছেন অনেকেই। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। আলজিরিয়া যখন সারাউই-দের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তখন কাস্ত্রোর সমস্ত সহানুভূতি পায় তারা। এমনকী ২০১৬-তে কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর তিনদিনের শোক পালিত হয়েছিল এই দেশে। হাভানাতে খোলা হয়েছে একটি অ্যামবাসিও।
কিন্তু, এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তো ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। ক্যাম্পের উদ্বাস্তু জীবনে নেই পড়াশোনার সুযোগও। শিক্ষাহীন জীবন তো সারাউই-এর শিশুদের ঠেলে দেবে আরো অন্ধকারে। সেই সমস্যারও সমাধান করেছিল কিউবা। বিগত দশকগুলিতে কয়েক হাজার শিশু পড়াশোনা করেছে কিউবাতে গিয়ে। কিউবার নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সারাউই-এর মিলনে এই প্রজন্মের নতুন নাম হয়েছে ‘কিউবারাউইস’ (Cubarauis)। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অনেকেই ফিরে আসে না আর। চলে যায় অন্য কোনো দেশে। ক্যাম্পগুলি পড়ে থাকে তিমিরে। আসলে, শৈশব-কৈশোর ক্যাম্পের মৃত্যুভয়ের সঙ্গে লড়াই করার পর শিক্ষার আলো পেয়ে পূরণ করতে চায় নিজের স্বপ্ন। ক্যাম্পে ফেরার পরেও অনেকে পালিয়ে যায় ইউরোপের কোনো দেশে। ভাষাগত সুবিধার কারণে স্পেনই এক্ষেত্রে মূল গন্তব্য। দেশকে হয়তো ভোলে না, কিন্তু ফিরেও আসতে চায় না দমবন্ধ পরিস্থিতিতে।
আরও পড়ুন
দেশের বাইরে না-গিয়েই বিশ্বভ্রমণ, বিভূতিভূষণের সঙ্গে মিলে যায় কিউবার কুলি-কবির গল্প
তাই কড়াকড়ি করতে বাধ্য হয়েছে সারাউই সরকার। ২০০০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমেছে প্রবাসী পড়ুয়ার সংখ্যা। এক দশক আগেও কিউবাতে পড়াশোনা করত ২০০ জন পড়ুয়া, এখন তার সংখ্যা ঠেকেছে মাত্র ১০ জনে। বদলে ‘হলিডে’স ইন পিস’ প্রজেক্টের অধীনে কিউবা, ভেনেজুয়েলা-সহ ইউরোপের বন্ধু দেশগুলিতে পড়ুয়া পাঠানো হয় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে। ফিরে আসাও একপ্রকার বাধ্যতামূলক। সিমোন বলিভিয়ার নামে সারাউইয়ের ক্যাম্পেও ২০২১ সালে খোলা হয়েছে একটি স্কুল। স্প্যানিশ ভাষায় প্রাথমিক পড়াশোনা হয় এখানেই। আগে যেখানে ১০ বছর বয়সেই শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হত কিউবায়, এখন প্রাপ্তবয়স্ক হলে তবেই মেলে বিদেশ যাওয়ার ছাড়পত্র। তাতে অবশ্য কমেছে পরিবারের থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকার কষ্ট।
আরও পড়ুন
গানের সূত্রে ঢুকে পড়বে পশ্চিমি পুঁজিবাদ; কিউবায় লেননকে নিষিদ্ধ করলেন ফিদেল কাস্ত্রো
আবার ফিরেও আসেন অনেকেই। স্বেচ্ছায় বরণ করে নেন ক্যাম্পের জীবন। ফিরে আসা কিউবারাউইস-রা দেশের মানুষদের শেখান বেসবল খেলা, কিউবার রান্নাবান্না। স্প্যানিশে-আরবিতে গল্পগুজব করে কেটে যায় জীবন। নিজেদের কোনো ‘একদেশীয়’ বলতে চান না তারা। যেন দুই দেশের ভিন্নধারার চেতনা আর ঐতিহ্যের রক্ত বইছে তাদের শরীরে। গোটা পৃথিবীটাই তো একটা বিরাট পরিবার। তাই ‘উদ্বাস্তু’ হয়েও তারা বিশ্বনাগরিক।
Powered by Froala Editor