‘মাই’ অর্থে আমরা সাধারণভাবে স্তন বুঝি, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মাতৃস্তন্য। বেশ-কিছু অভিধানও সে-অর্থের দিকেই নির্দেশ করে। তবে স্তনের চলিত ডাক কবে থেকে ও কেন যে মাই হল, সে এক ধাঁধা। ‘মাই’ শব্দটির উৎস খুঁজলে উঠে আসে সংস্কৃত ‘মাতৃ’, অর্থাৎ ‘মা’। সেই মাতৃ-ই ভাঙতে-ভাঙতে পরিণত হল মাই-তে। অথচ শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন লেখেন—‘উলঙ্গ কিশোরী তোমার মাই দুটো সন্ন্যাসেই মস্ত’, সেই প্রয়োগ হয়ে ওঠে স্তনের অর্থবাহী। স্ল্যাং-অভিধানের ভেতর, হয়ে ওঠে অপশব্দও। এভাবেই ‘মা’-অর্থ বদলে গেল মাতৃস্তন্যে, দিনে-দিনে যে-কোনো নারীর স্তনেই।
মাতৃ>মাতা>মাই-এর সূত্র সংস্কৃত, আগেই বলেছি। এদিকে স্তন-অর্থে ব্যবহৃত ‘মাই’ নিতান্তই গ্রাম্য শব্দ। এই রূপান্তর কীভাবে? অনুমান, পুরুষশাসিত সমাজে সন্তানকে স্তন্যপান করানো আর মাতৃত্ব একরৈখিকভাবে দেখা শুরু হয়েছিল কখনো। মাতৃত্বের বিস্তৃত অর্থ তখনই সীমায়িত হয়ে যায় স্তন্যদানে। আর, গ্রামবাংলায় মাই-সম্বোধন প্রচলিত থাকায়, সরলীকরণে বিশেষ বাধাও আসেনি বোধকরি। সেই থেকে ‘মাই’-এর দ্বৈত অর্থ চলছে পাশাপাশি।
আজকের ‘প্রমিত’ বাংলাভাষায় মা-অর্থে মাই-এর ব্যবহার নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই শব্দ বুঝি অবাঙালিদের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল বঙ্গদেশে। বিশেষ কিছু ব্যবহারের দিকে নজর দিলে, সে-কথা সত্যিও। তবে মাতৃ থেকে মাই-এর রূপান্তর সংস্কৃত-নির্ভর একাধিক ভাষাতেই হয়েছে। বাংলাতেও, মাই—প্রাচীন বানানে ‘মাঈ’, মা-অর্থে এককালে ব্যবহৃত হত। এমনকী, মাতৃস্থানীয়া কোনো নারীকে সম্বোধনের ক্ষেত্রেও। আবার, কখনো-কখনো নারী, কন্যা বা ভগিনী অর্থে, যার আরেকটি রূপ ‘মাইয়া’ ।
যে-ভাবনা থেকে এই আলোচনার অবতারণা, ‘বলো দুর্গা মাইকি জয়’ কিংবা ‘বলো কালী মাইকি জয়’—এই জয়ধ্বনি কি বাঙালির? হতে পারত, যদি-না ‘কি’—যার অর্থ ‘এর’—যোগ হত মাই-এর সঙ্গে। কি-যুক্ত হয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠল অবাঙালি-সংযোগ। মাইকি—‘শুদ্ধ’ বাংলা হলে, হতে পারত ‘মায়ের’। ‘বলো দুর্গা মায়ের জয়’ বা ‘বলো মা দুর্গার জয়’—ফ্যাকাশে শোনাচ্ছে বুঝি? নাকি আমাদের কানই এতে অনভ্যস্ত? যেন মনে হয়, ‘মায়ের’ উচ্চারণে পেলবতা ও আদুরেপনা রয়েছে; তা ফিসফিসিয়ে বলার, চিৎকার করার নয়। ‘মাইকি’ সেখানে আলাদা তীব্রতা আনে, মা-ও হয়ে ওঠেন শক্তিস্বরূপিণী। মদ্যপান বা গঞ্জিকাসেবনও কি ঐতিহাসিকভাবে ভক্তের তীব্রতাদানে সাহায্য করেছে?
আরও পড়ুন
‘প্রত্যয়’-এর পুজো পরিক্রমা এবং ‘মূলস্রোত’-এ ফেরার মহোৎসব
‘মাইকি’ শব্দটি বাঙালির অভ্যস্ত ভাষ্যে নেই; বলাই বাহুল্য, অবাঙালিদের থেকে ধার নেওয়া। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গপ্রদেশ থেকে যুগ-যুগ ধরে অবাঙালিরা এসেছেন বাংলায়—কখনো ধর্মপ্রচার করতে, কখনো আবার জীবিকার জন্যেই। তাঁদের বুলিতে ‘মা’ হয়ে উঠেছেন ‘মাই’। দেবীদের জয়ধ্বনি দিতে গিয়ে, ‘বলো’ হয়েছে ‘বোলো’-ও। দুর্গা হয়েছেন ‘দুগ্গা’, অবশ্য বাঙালির অনাড়ম্বর উচ্চারণেও দুর্গা-র বিশ্লিষ্ট হওয়া অসম্ভব নয়। ‘বোলো দুগ্গা মাইকি জয়’—এই অবাঙালিদের এই সোচ্চার উল্লাসে প্রভাবিত হয়েছে বাঙালি। খোঁজ পেয়েছে জয়ধ্বনিতে লুকিয়ে থাকা ‘ফোর্স’-এর। যেভাবে ‘জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি’—কালীঘাটের কালীর ক্ষেত্রেও ঝুঁকেছে তারা। তবে তা সর্বজনস্বীকৃত হয়নি, যেমনটি হয়েছে ‘মাইকি’।
আরও পড়ুন
ঔষধি গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গা মন্দির
ফিরে যাওয়া যাক শুধুমাত্র ‘মাই’-তে। এই সম্বোধন বহির্বঙ্গে বহুল প্রচারিত, তবে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষীণ। উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের লোকসঙ্গীতে মাই-এর হাজিরা পাওয়া যায়। ‘আর বাট্টায় আছে মাই তোর পানগুয়া/ কাঁয় বা খাবে মাই তোর পানগুয়া’—এখানে মাই অর্থ ‘মেয়ে’, এক যুবক যুবতীকে সম্বোধন করে বলছে। ‘ও মোর সুন্দরী/ তোক না নিলে মোর জলম মিশ্শা/ কতয় কান্দিম মাই তোক দেখিয়া’ ইত্যাদি। ফলে, সার্বিকভাবে ‘মাই’ সম্বোধন শুধু মা-তেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, হয়ে উঠছে অন্য-অন্য নারীকেন্দ্রিক সম্পর্কেরও আধার। তবে সেসব উদাহরণ নিতান্তই দুর্লভ। মা-অর্থ যেভাবে রাজত্ব করেছে, তেমনটি আর-কিছুই পারেনি।
গোবিন্দচন্দ্রের গানের উৎপত্তিকাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ওইসব গান-গাথা দ্বাদশ শতাব্দীর রচনা; সুকুমার সেন আবার আঠেরো শতকের পিছনে যেতেই রাজি নন। সে যাই হোক, উত্তরবঙ্গ থেকে সংগৃহীত গোপীচন্দ্রের গানে ‘মা’-সম্বোধনে ‘মাই’-এর ছড়াছড়ি। কখনো তা ময়নামতীর প্রতি, কখনো আবার গোয়ালিনী, বসুমাতা সহ অন্যদের উদ্দেশে। এমনকি, হলুদ, শাক, কলাই ইত্যাদির বিক্রেতা নারীরাও ‘মাই’ হয়ে উঠছেন— ‘বান্দা নেও বান্দা নেও হলদি বেচি মাই’, বান্দা নেও বান্দা নেও সাক বেচি মাই’ ইত্যাদি। আবার, আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে গোপীচন্দ্র বলছেন—‘মানিকচন্দ্র রাজার স্ত্রী মএনামতি মাই’, সেই ময়নারই ছেলে আমি। এভাবেই, বাংলার অন্যতম প্রাচীন (তর্কসাপেক্ষ) এক গীতি-দলিলে, অবাঙালিদের প্রভাব ছাড়াই, বাঙালির নিজস্ব মাই-এর উপস্থিতি স্পষ্ট।
পৌঁছে যাই বিদ্যাপতির কাছে। তাঁর লেখা ‘শিবসঙ্গীত’-এ বেশ-কিছু উদাহরণ রয়েছে, গৌরীকে উদ্দেশ্য করে—‘ভনহি বিদ্যাপতি সুন গৌরী পারবতী/ তুহুঁ যে বড় তপ কৈলহি, গে মাই’ কিংবা ‘জোগিয়া এক হম দেখল গে মাই/ অদ্ভুত রূপ মোহি কহলো নে জাই’ ইত্যাদি। তবে বিদ্যাপতিকে যতই ‘বাঙালি’ বলা হোক না কেন, তিনি ছিলেন মিথিলা অঞ্চলের বাসিন্দা, আর সেখানে ‘মাই’ শব্দ প্রচলিত প্রাচীনকাল থেকেই। এদিকে, রামপ্রসাদ যখন ব্রজবুলিতে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন, তাঁর গানেও দেখা যায়—‘চলগো মন্দাকিনী জলে শিব পূজ বিল্বদলে/ মাই শুন ওলো, মাইকি ভাষ।’ অথচ এই রামপ্রসাদ খাঁটি বাংলায় লেখা অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীতে ‘মাই’ লেখেননি কখনোই, বারংবার ঘুরে-ফিরে এসেছে ‘মা’। বোঝা যায়, বাঙালি দীর্ঘদিন ধরে ‘মাই’ সম্বোধন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও, লিখিত বাংলাভাষায় খুব বেশি অন্তর্ভুক্তি ঘটায়নি।
একদমই যে নেই, এ-কথা বললে অন্যায় হবে। ষোড়শ শতকে কাশীদাসী মহাভারতের আদিপর্বে দেখতে পাই—‘এহার বৃত্তান্ত আরে কহ সুনি মাই।’ মা-অর্থেই যে এর ব্যবহার, বলাই বাহুল্য। পরবর্তী শতকে, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’-এও একাধিকবার ‘মাই’-এর উল্লেখ। মূলত মনসার কথাই—‘বিষহরি মাই’। এখানে মনসার পিতা শিবের মাই-সম্বোধন আসলে কন্যার প্রতিই—‘মহেশ বলেন শুন বিষহরি মাই।’ আবার, ‘মা মনসা’-ও বোঝানো হয়েছে একাধিকবার, তা ‘এতেক শুনিয়া বলে বিষহরি মাই’, ‘এই উপদেশ বলেন বিষহরি মাই’ ইত্যাদি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট। এ আসলে ভক্ত কবির মা-ডাক।
বৈষ্ণব পদাবলির ক্ষেত্রে, ব্রজবুলি বা হিন্দিতে রচিত পদে ‘মাই’-এর ব্যবহার প্রচুর, সঙ্গত কারণেই। পূর্বোক্ত বিদ্যাপতিই তার প্রমাণ। কিন্তু বাংলায় রচিত পদাবলিতেও মাই-সম্বোধন অবাক করে। গোবিন্দদাস লিখছেন—‘কহে রাধা ঠাকুরাণী, শুন ওগো মাই নন্দরাণী’ কিংবা ‘এস এস এস বৈস বৈস বৈস—কহে যশোমতী মাই’। আবার বংশীদাসের পদে পাই ‘শুন ওগো বড়ি মাই, গা মোর কেমন কেমন করে’—রাধার উক্তি। ‘বড়ি মাই’ কি বুড়ি মাই-এর অপভ্রংশ? নতুবা, ‘বড়ি’ শব্দটির অবাঙালিত্ব নিয়ে আলোচনার বিস্তার ঘটানো যেতে পারে।
প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ ছেড়ে হাল আমলে নজর দিলে দেখি, ‘দুর্গা মাইকি’, ‘কালী মাইকি’ ইত্যাদির বাইরেও, ‘গঙ্গা মাইকি’ বা ‘যমুনা মাইকি’ জয় চেয়ে অন্যদের সঙ্গে গলা মেলানোয় অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল বাঙালি। গদ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অজস্র সাক্ষ্য, প্রায় সবগুলিই অবাঙালি রমণীকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে। আর পদ্যে? উদাহরণ পাই অতুলপ্রসাদের গানে—‘ভাইকে ছুঁলে পদতলে/ শুদ্ধ হোস তুই গঙ্গাজলে;/ ওরে সেই অছুঁৎ ছেলেই কোলে তুলে/ তুষ্ট হন যে গঙ্গা-মাঈ।’ সম্পূর্ণ গানটির অন্ত্যমিলে নজর দিলে উঠে আসে ভাই/তাই/সবাই/একজনাই/ঠাঁই/বালাই/দোহাই ইত্যাদি শব্দ। এসবের সঙ্গে মিল রাখতেই ‘মাঈ’ লিখেছেন অতুলপ্রসাদ। ১৯৩৩ সালে, কবিরাজ তারকেশ্বর সেন শাস্ত্রী ‘নদিয়া বিলাস’ গ্রন্থে পদাবলি ও কথকতার ভিতর ‘মাই’-এর আগমন ঘটিয়েছেন, দ্বিবিধ অর্থেই। কথকতার অংশে নিমাই-এর প্রসঙ্গে পাই ‘মায়ের মুখ চায় মাই খায়’—এখানে স্পষ্টতই মাতৃস্তন্য বোঝানো হয়েছে। আবার, পরবর্তীতে একাধিক উল্লেখ আছে মা অর্থে—‘এহেন সংকল্প কভু না কর নিমাই।/ যুবতী রমণী ঘরে আরও আছে মাই।।’ ইত্যাদি, মূলত শচীদেবীকে বোঝাতেই। একবার বধূমাতা অর্থাৎ বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রসঙ্গে রয়েছে ‘হায় কি হইল বধূ মাই হায় রে।’
তবে সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের নিরিখে এসব উদাহরণ খুবই অল্প। ‘বোলো দুর্গা মাইকি জয়’—এই জয়ধ্বনিতে বাংলার প্রাচীন ‘মাই’ সম্বোধনের উত্তরাধিকার কতটুকু, তা বিবেচ্য। কি-এর উপস্থিতিই বহির্বঙ্গের প্রভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। গদ্য-কবিতায়, চরিত্র বা পরিবেশের আনুকূল্য না পেলে, ‘মাই’ বা ‘মাইকি’ স্বাভাবিক হয়নি আজও। হওয়ার কথাও না, কেন-না ‘মাই’ ও ‘কি’ দুটি শব্দই ‘প্রমিত’ ভাষাশিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির অনভ্যাসের। অথচ, অসচেতনভাবেই, দেবীর জয়ধ্বনিতে ঠাঁই পেল ‘মাইকি’। দিনে-দিনে মিশে গেল স্রোতে। এবার, একই সূত্রে ভাবুন কোনো ব্যক্তির সম্বোধনে ‘জি’-এর প্রয়োগ। কিংবা ভোলানাথের ‘ভোলেনাথ’ হয়ে যাওয়া। এ-সবই অবাঙালিদের থেকে পাওয়া; দেখে ও শুনে আত্তীকরণ। নেওয়ার সময় যেমন আটকানো যায়নি, আজকের দিনে উপড়ে ফেলাও তেমনই অসম্ভব। ভাবা যায়, চলতে পারে আলোচনাও, কিন্তু বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা অর্থহীন...
আলোকচিত্র: লেখক
গ্রন্থঋণ:
অতুলপ্রসাদ সেন, গীতিগুঞ্জ, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, ১৩৩৮
কৈলাসচন্দ্র সিংহ সম্পাদিত, সাধক-সঙ্গীত, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত, ১৩০৬
চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংগৃহীত, শ্রীশ্রীপদামৃতসিন্ধু, শাস্ত্রপ্রকাশ কার্য্যালয়, ১৩২৯
তারকেশ্বর সেন শাস্ত্রী, নদিয়া বিলাস, উপেন্দ্রনাথ কর কর্তৃক প্রকাশিত, ১৩৪০
দীনেশচন্দ্র সেন ও বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত, গোপীচন্দ্রের গান, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২২
নির্মলেন্দু ভৌমিক, প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৭
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বিরচিত ‘মনসামঙ্গল’, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৯
সুধীরচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত, ‘বিদ্যাপতির শিবগীত’, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬২
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত, কাশীরাম দাস বিরচিত ‘মহাভারত’, আদিপর্ব, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৩৫
Powered by Froala Editor