বছর তিনেক আগের কথা। কোভিড অতিমারি আর লকডাউনে বিধ্বস্ত ভারতবাসীর জীবনে এসে হাজির হয়েছিল একের পর এক ওয়েব সিরিজ। মানে সেই ভারতবাসী, যারা কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে ছিল পারিপার্শ্বিক আতঙ্ক থেকে। সুদূর কেরালা থেকে যাদের পায়ে হেঁটে বাংলায় ফিরতে হয়নি। সেই অখণ্ড অবসরের দিনগুলিতে হিন্দি ভাষায় একটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। তেমন কিছু নয়। সেই সিরিজের একটি দৃশ্যে ক্ষুদিরাম বসুর ছবি ঝোলানো ছিল অপরাধীদের তালিকায়। কিছুদিন এই নিয়ে খুব বাকবিতণ্ডা হয়। পাঠানো হয় আইনি নোটিশও। তারপর সব চুপ। সেই সিরিজে, সেই দৃশ্যটি আজও আছে কিনা, দেখা হয়ে ওঠেনি আর।
সিনেমাজগতে ঐতিহাসিক তথ্যবিকৃতির ঘটনা নতুন কিছু নয়। বৃহত্তর উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে ভেঙেচুরে দেখা নিয়ে অনেকে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা জুড়ে দিতে পারেন। নিয়ে আসতে পারেন আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’-এর সেই বিখ্যাত উদাহরণ। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি পাতি অবহেলা ছাড়া কিছুই নয়। আর নাহলে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভ। সাম্প্রতিক ‘সম্রাট পৃথ্বীরাজ’-এর মতো সিনেমার কথাই মনে করা যাক এ প্রসঙ্গে। আর শুধুই কি বলিউড? ২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত খুবই জনপ্রিয় তেলুগু সিনেমা ‘শ্যাম সিংহ রয়’-তে উনিশ শতকের বাঙালি নায়কের বইয়ে আজকের দিনের ‘ফন্ট’ বড্ড চোখে লাগে। নিশ্চয়ই অন্য ভাষার মানুষদেরও অস্বস্তি হয় তাদের সংস্কৃতির বিরূপ উপস্থাপনে। বর্তমান সমস্যা হচ্ছে এ আর রহমানের (A R Rahman) ‘সুর’ করা নজরুলগীতিটি নিয়ে। বিষয়টি শুনতে ‘হাঁসজারু’-র মতো হলেও, আদতে এটাই সত্যি। কাজি নজরুল ইসলামের (Kazi Nazrul Islam) ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটিতে নতুন করে সুরারোপ করেছেন রহমান। তিনি অস্কারজয়ী সংগীতপরিচালক, অসংখ্য অসাধারণ গান উপহার দিয়েছেন ভারতের জনতাকে। ফলে প্রথমেই বাঙালি বিদ্বেষ, ইতিহাসের বিকৃতি ইত্যাদি মতামত চাপিয়ে দিতে একটু সংকোচই হচ্ছে।
ঠিক কী করেছেন তিনি গানটি নিয়ে? নজরুলের ‘ভাঙার গান’-এর রৌদ্র রসের লেশমাত্র নেই নতুন অ্যারেঞ্জমেন্টে। লোকসঙ্গীতের ধাঁচ কিছুটা থাকলেও, সুরের মধ্যে প্রচলিত রোম্যান্টিক গানের ধরনটাই কানে লাগে বেশি করে। রাজাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত ‘পিপ্পা’ সিনেমাটিতে ব্যবহৃত হয়েছে এই গানটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে নির্মিত সিনেমাটির জন্য ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর চেয়ে আদর্শ গান মেলা একপ্রকার দুষ্কর। কিন্তু রহমান সাহেবের পরিকল্পনায় হারিয়ে গেছে সেই তীব্রতা, রক্তের মধ্যে ছলকে ওঠা সেই বিদ্রোহ। স্বাভাবিকভাবেই অখুশি বাঙালি শ্রোতারা। সমাজমাধ্যম ভরে উঠছে প্রতিবাদ আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপে। অথচ এর আগে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যথা ভয় শূন্য’ কবিতাটিতে সুর দিয়েছেন। উচ্চারণের ত্রুটি সত্ত্বেও অধিকাংশ শ্রোতাই পছন্দ করেছিলেন গানটিকে। কিন্তু এবার কী করে এমন আশ্চর্য গণ্ডগোল তিনি করে বসলেন, সেটাও অনেকের প্রশ্ন। একটা অত্যন্ত সহজ উত্তর হতে পারে, তিনি ‘ভাঙার গান’-এর শাব্দিক মহিমা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি। আবেগের প্রসঙ্গ নাহয় বাদই রাখছি আপাতত। শুধুমাত্র ইতিহাসটুকু পাঠ করলেই হয়তো ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করার ক্ষেত্রে আরও সাবধানী পদক্ষেপ নিতে পারতেন।
মুজফফর আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী গানটির রচনাকাল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। নজরুলের বয়স তখন ২২ বছর। সে বছরই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকা। গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্থান তখন ইংরেজের কারাগারে। বাদ গেলেন না চিত্তরঞ্জন দাশও। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর আবেদনে নজরুল লেখেন ‘ভাঙার গান’। ১৯২২-এর ২০ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় কবিতাটি। শোনা যায়, হুগলির জেলে দেশবন্ধু ও অন্যান্য বন্দিরা একসঙ্গে গেয়ে উঠতেন এই গান। যেখানে ‘তরুণ ঈশান’-কে তিনি ডাক দেন প্রলয়-বিষাণ বাজানোর জন্য। আর হজরত আলির যুদ্ধের ডাকে ধ্বংস করেন মৃত্যুকে। শেষে বলেন বন্দিশালায় আগুন জ্বালানোর কথা। জনমানসে প্রলয়ঙ্করী প্রভাব দেখে শঙ্কিত ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হন গানটিকে। ১৯৪৯ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমাতে প্রথম ব্যবহার করা হয় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণার অন্য নাম হয়ে উঠেছিল ‘ভাঙার গান’।
আরও পড়ুন
সুপ্রিম কোর্টে আইনত স্বীকৃতি পেল না সমলিঙ্গের বিবাহ, কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত?
যার সঙ্গে দুটি দেশের স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী ইতিহাস জড়িয়ে, তাকে নিয়ে সচেতনতার অভাব হয় মূর্খামি, নয়তো আস্পর্ধা। এক্ষেত্রে একেবারেই খাটে না গানের ভাবগত অর্থ না জানার যুক্তি। সে দায়িত্ব কার? নিশ্চয়ই সুরকার ও তার দলের। সে কাজেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ তারা। একই সঙ্গে তো প্রশ্ন উঠবে গায়ক-গায়িকাদের নিয়েও। তাঁরা তো বাঙালি। গানটি গাওয়ার সময় কি একবারও খেয়াল হয়নি ঐতিহ্যটুকু স্মরণ করিয়ে দেওয়া? অবশ্য ভিতরের ঘটনা কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যেখানে টাকাই শেষ কথা বলে, সেখানে আদৌ যদি প্রতিবাদ হয়েও থাকে, তা আরব সাগরের জলেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেকটা কথা হতে পারে শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে। কিছুদিন আগেই একটি ইন্টারভিউতে এ আর রহমান বলছিলেন তাঁর সুর করা গানের ‘রিমিক্স’ নিয়ে। একই অভিযোগ কি এবার তাঁর ক্ষেত্রেও খাটে না? কপিরাইটের ক্ষেত্রে ঠিক কী কথা হয়েছে, তা এই মুহূর্তে প্রযোজক সংস্থা আর কাজি নজরুলের পরিবারের লোকেরা ছাড়া কেউই বলতে পারবে না। সেসব বাদ রেখেই চোখে পড়ে বলিউডি সিনেমার সেই চিরাচরিত ফর্মুলা। নতুন মোড়কে পুরনো জিনিস খাওয়ানোর পদ্ধতি। ভালো লাগলে দর্শক-শ্রোতা সেটি নেবে, নয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এটা যদি যুক্তি হয়, তাহলে বুঝতে হবে নজরুলের গানকে এঁরা পণ্যের চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি।
আরও পড়ুন
স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ : গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের এক বিস্মৃতপ্রায় কাণ্ডারি
আর সেই প্রসঙ্গেই মনে হচ্ছে আরেকটি বিষয়। গানটি নিয়ে সমালোচনা হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ জানত না ‘পিপা’-র কথা। ওটিটি-তে মুক্তি পাবে ছবিটি, খুব জনপ্রিয় কোনো মুখও নেই তাতে। বেশি বাজেটের সিনেমা নয় সম্ভবত। ট্রেলারের একটি অংশে এক অভিনেত্রীকে বলতে শোনা যাচ্ছে ‘ডাক্কা’-র কথা। ‘ঢাকা’-ই বলতে চেয়েছিলেন সম্ভবত। মুক্তি বাহিনী বলছে ‘বাংলার জয়’। এই তো গবেষণার অবস্থা! আর তাছাড়া ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, ‘রসুগুল্লা’-এর মতো স্টিরিওটাইপ থেকে মুক্তি এখনও দূরস্থ। কিছুদিন আগেও একটি সিনেমায় অবাঙালি যুবকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাদাজি’। লঘুস্তরে ঠাট্টা-ইয়ার্কির মধ্যেই বড়ো বেশি চোখে পড়ে ফাঁকিগুলি। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ সমস্ত আগল ভেঙে দিয়েছে। প্রতিবাদ চলছে এই নিয়ে। লাভ হল কার? অবশ্যই প্রযোজকের। লোকের কাছে সিনেমার নাম পৌঁছোল। অনেকেই আগ্রহী হয়ে দেখবে। ভালোও লাগতে পারে। নজরুলের সূত্র ধরে আসলে পণ্যে পরিণত করা হল সবাইকেই।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
Powered by Froala Editor