সময়টা ১৮৯৭ সালের মে মাস। ‘Archibald Constable and Company’ থেকে প্রকাশ পেল ব্রাম স্টোকারের (Bram Stoker) লেখা একটি গথিক উপন্যাস। হলদে মলাটের ওপরে রক্তলাল হরফে লেখা বইটির নাম– ‘Dracula’। কদিনের মধ্যেই সমসাময়িক ‘Daily Mail’ পত্রিকা সোচ্ছ্বাসে মেরি শেলি, এডগার অ্যালান পো ও এমিলি ব্রন্টির থেকেও উচ্চস্থান দিল স্টোকারকে। সেই শুরু, তারপর শতাধিক বছর ধরে ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম– ড্রাকুলা।
কী ছিল এই উপন্যাসে? সকলেই জানেন, তবুও কাহিনিটি সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক।
লন্ডনের তরুণ সলিসিটার জোনাথন হারকার কাউন্ট ড্রাকুলার আহ্বানে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর ট্রানসিলভানিয়াতে। লন্ডনে বেশ কিছু জমি ও বাড়ি খরিদ করতে চেয়েছিলেন ড্রাকুলা, সেসব ব্যাপারে আইনি সাহায্য করার জন্যেই জোনাথনকে তাঁর প্রয়োজন ছিল। ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে পৌঁছে প্রাথমিকভাবে আদর-আপ্যায়নে মুগ্ধ হলেও, ক্রমে ড্রাকুলার ভয়াবহ ‘ভ্যাম্পায়ার’-সত্তা প্রকাশ পেতে থাকে জোনাথনের কাছে, সেই দুর্গের আরো তিনজন রক্তপায়ী নারীর সঙ্গেও মোলাকাত হয় তাঁর। কাজ মিটে গেলে, সেই পিশাচিনীদের শিকার হিসাবে জোনাথনকে দুর্গে আটকে রেখে জিপসি অনুগামীদের সাহায্যে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন ড্রাকুলা।
হুইটবিতে বান্ধবী লুসির কাছে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন জোনাথনের বাগদত্তা মিনা। ইংল্যান্ডে আসার পর এই লুসিকেই ড্রাকুলা তাঁর প্রথম শিকার হিসাবে বেছে নেন। ডক্টর ভ্যান হেলসিং-এর প্রাণপণ প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দিয়ে, রাতের পর রাত রক্তশোষণ করে লুসিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন ড্রাকুলা। এখানেই শেষ নয়, মৃত্যুর পর লুসিও ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়ে স্থানীয় শিশুদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করেন। ভ্যান হেলসিং তাঁর তিন তরুণ সহযোগীর সাহায্যে লুসির আত্মাকে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই পৈশাচিক দশা থেকে মুক্তি দেন।
আরও পড়ুন
গল্পের নয়, রক্তের জন্য পাগল সত্যিকারের ড্রাকুলা থাকতেন এখানেই
ইতিমধ্যে, ট্রানসিলভানিয়া থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন জোনাথন; মিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি। এই দম্পতিও ড্রাকুলার বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভ্যান হেলসিঙের পাশে দাঁড়ান। ড্রাকুলা এবার মিনার উপরে আক্রমণ শানান। কিন্তু ভ্যান হেলসিং ও তাঁর বন্ধুদলের বিরোধিতায় লন্ডন আর ড্রাকুলার জন্য নিরাপদ থাকে না, জিপসি অনুগামীদের সাহায্যে ট্রানসিলভেনিয়ায় প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন ড্রাকুলা। সদলবলে ভ্যান হেলসিং তাঁর পিছু নেন, এবং প্রাসাদদুর্গে প্রবেশের আগেই ড্রাকুলার শিরশ্ছেদ করে তাঁকে মুক্তি দেন এই পিশাচ-দশা থেকে। মিনা লক্ষ্য করেন, নিহত হবার সময় ড্রাকুলার মুখে ফুটে ওঠে এক পরম প্রশান্তির ভাব।
আরও পড়ুন
হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও
গত কয়েক দশক ধরে সমালোচকেরা এই উপন্যাসের নানা বিচিত্র ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। সি এফ বেন্টলির মতে, ড্রাকুলা চরিত্রটি ফ্রয়েড-কথিত ‘ইদ’-এর মূর্ত রূপ। ক্যারল এ সেফ উপন্যাসটিকে “New Woman Archetype”–এর একটি প্রতিক্রিয়া হিসাবে পড়তে চান, আবার ক্রিস্টোফার ক্র্যাফট বলেন, এই উপন্যাসে ড্রাকুলার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল সমকামী প্রবৃত্তি। স্টিফেন ড আরাটা এই উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছেন ঔপনিবেশিকতা ও জাতিগত মিশ্রণ সংক্রান্ত উদ্বেগ। ফ্র্যাঙ্কো মরেটি বলেছেন, তাঁর মতে ড্রাকুলা একচেটিয়া পুঁজিবাদের প্রতীক। আবার রবার্ট নোল এই উপন্যাসটিকে উনিশ শতকের মনোবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। ড. ব্রুনো স্টারস এই উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয়ঘোষণার কাহিনির মোড়কে সূক্ষ্ম ধর্মপ্রচার। ভিক্টোরিয়ান যুগের যৌনতা ও অপরাধ-মনস্তত্ত্বের একটি স্পষ্ট ছাপ এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। তাই মনোবিজ্ঞান, নারীবাদ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি– এই সব কিছুর আলোকেই বারবার নতুন করে বিশ্লেষিত হচ্ছে এবং হয়ে চলেছে কালজয়ী এই উপন্যাস।
ড্রাকুলার কাহিনি কি নেহাতই কল্পিত, নাকি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাবীজ থেকে এই উপন্যাসের জন্ম? এই প্রশ্নেরই উত্তর সন্ধান করেছেন রাডু ফ্লোরেস্কু এবং রেমন্ড ম্যাকনেলি, তাঁদের ‘In Search of Dracula’ বইটিতে। তাঁদের মতে, ট্রানসিলভানিয়ার কুখ্যাত শাসক “ভ্লাড থ্রি ড্রাকুলা”-র আদলেই ব্রাম স্ট্রোকার এই চরিত্রটিকে গড়ে তুলেছিলেন। ইতিহাস বলে, প্রায় চল্লিশ হাজার থেকে এক লক্ষ ইউরোপিয়ান জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন এই ভ্লাড। উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ড্রাকুলা তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং পরে তিনি নিজের ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। এ তথ্যটিও ভ্লাডের সঙ্গে মিলে যায়। ক্লেয়ার হাওয়ার্ড মেডেন তাঁর ‘The Essential Dracula’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ড্রাকুলার প্রাসাদ-দুর্গের বিবরণ দেওয়ার ব্যাপারে সম্ভবত লেখক স্কটল্যান্ডের “Slains Castle”–এর খুঁটিনাটির উপরে নির্ভর করেছিলেন, কারণ তিনি নিজে বেশ কিছুদিন এই দুর্গে আতিথ্যভোগ করেছিলেন। যদিও, এই মত বিতর্কমুক্ত নয়। লণ্ডন ও হুইটবির নানা দৃশ্য লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই আঁকা, তবে গল্পের খাতিরে তিনি মাঝেমধ্যেই ভৌগোলিক বাস্তবতার বিপর্যয় ঘটিয়েছেন।
১৯১৪ সালে, ব্রাম স্টোকারের মৃত্যুর বছর দুয়েক বাদে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর নামাঙ্কিত একটি ছোটগল্প– ‘Dracula’s Guest’। সমালোচকদের মতে, এটি হয়তো মূল উপন্যাসেরই একটি অধ্যায় হিসাবে লেখা হয়েছিল, পরে বাহুল্যবোধে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে, ব্রাম স্টোকারের উত্তরপুরুষ ডাক্রে স্টোকার ও ইয়ান হল্ট লিখে ফেললেন ড্রাকুলা কাহিনির একটি অনবদ্য সিক্যুয়েল – ‘Dracula the Un-dead’। ২০১৮ সালে প্রকাশ পেল ডাক্রে স্টোকার ও জেদি ডি বার্কারের লেখা একটি প্রিক্যুয়েল– ‘Dracul’। এই বই দুটি পাঠকদের কাছে বিপুল অভিনন্দন পেয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন লেখকদের ড্রাকুলা তথা ভ্যাম্পায়ার নিয়ে লেখা অজস্র কাহিনি তো আছেই। এ ব্যাপারে উল্লেখ করতেই হবে একেবারে হাল আমলে স্টিফেন মেয়ারের চারটি উপন্যাস নিয়ে গড়া অসামান্য ভ্যাম্পায়ার সিরিজটির কথা – ‘Twilight’, ‘New Moon’, ‘Eclipse’, ‘Breaking Dawn’। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই সিরিজের উপন্যাস আর চলচ্চিত্র– দুইই বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
লেখক স্বয়ং ‘Dracula, or The Undead’ নামে এই উপন্যাসের নাট্যরূপ রচনা করেছিলেন। ১৮৯৭ সালের ১৮ মে লিসিয়াম থিয়েটারে সে নাটক অভিনীত হয়েছিল। তারপরে এই উপন্যাস অবলম্বনে লেখা হয়েছে বহু নাটক, নির্মিত হয়েছে অজস্র চলচ্চিত্র। ১৯৫৮ সালে ক্রিস্টোফার লি অভিনীত ‘Horror of Dracula’ ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৭৭ সালে বিবিসি এই উপন্যাস অবলম্বনে ‘Count Dracula’ নামে একটি সিনেমা বানায়, এতে নামচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন লুইস জর্ডন। ১৯৯২ সালে গ্যারি ওল্ডম্যান ড্রাকুলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ‘Bram Stoker’s Dracula’ সিনেমাটিতে। আরো কত চলচ্চিত্র যে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস নিয়ে, তার তালিকা দিতে গেলে শেষ হবে না।
অনেকের মতে, শার্লক হোমসের পরে ড্রাকুলাই ইংরেজি উপন্যাসের সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র! আজ, এত বছর পরেও, ড্রাকুলার জনপ্রিয়তা অক্ষয় ও অম্লান।
Powered by Froala Editor