এদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রায় রোজকার ঘটনা। বন্যা, ধস, ভূমিকম্প— আর তাতে গ্রামাঞ্চলের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া। এসব দৃশ্যের সঙ্গে শহুরে চোখও বেশ পরিচিত। কিন্তু দৃশ্যমান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বাইরে অ-দৃশ্য হয়ে থাকে আরো অসংখ্য বিপর্যয়। মূলধারার সংবাদমাধ্যম যে বিপর্যয়ের খবর নিয়ে আসে, যে রিলিফ বা ত্রাণের খবর ধরা পড়ে, তা আংশিক। তাতে সম্পূর্ণ ক্ষত মেটানো আদৌ সম্ভব? প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠিটুকু না বুঝে, যে-কোনো জায়গায় ত্রাণ পৌঁছে দিলেই কি দায় মেটে?
এসব আলোচনাতেই কাটল গতসন্ধ্যা। দক্ষিণ কলকাতার অফবিট সিসিউ ক্যাফে 'গুঞ্জ'নে মুখরিত হল। প্রান্তকথা (Prantakatha) এনজিও-র কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন গুঞ্জ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা অংশু গুপ্তা (Angshu Gupta)। সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নানান জেলা থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা। গুঞ্জ-এর কাজ, কাজের ধরণ জানতে, অংশু গুপ্তার অভিজ্ঞতা থেকে ঋদ্ধ হতে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা।
র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার প্রাপ্ত (২০১৫) অংশু গুপ্তা 'বিপর্যয়' ও 'ত্রাণ'-এর ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছেন তাঁর কুড়ি বছরের কর্মজীবনে। তাঁর বক্তব্য, যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে, কেন তার মোকাবিলার জন্যে আগে থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। 'রিলিফ'এর জন্যে কেনই বা বিপর্যয়ের অপেক্ষা করতে হবে? এদেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন অসংখ্য মানুষ। দারিদ্র কি নিজেই একটি বিপর্যয় নয়?
এসব ভাবনা থেকেই জন্ম 'গুঞ্জ'-এর। যাত্রা শুরু হয়েছিল কাপড় বা বস্ত্রের কথা মাথায় রেখে। 'রোটি কাপড়া মকান'- মূলগত চাহিদার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জুড়ে থাকা যে কাপড়— তা আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। আর কাপড় যখন কোনো বিপর্যস্ত এলাকায় রিলিফ-হিসেবে পৌঁছয়, তখন সেই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ভৌগোলিক জীবনাচরণের কথা খেয়াল থাকে না অনেকক্ষেত্রেই। তার কী প্রয়োজনীয়তা, মনে রাখা হয় না তাও। শিশু, মহিলা বা পুরুষ— স্থানভেদে আর্থ-সামাজিক অবস্থাভেদে তাদের কাপড়ের পরিমাপ ও পরিমাণও ভিন্ন হয়। পাশাপাশি কাপড় শুধু পরিধেয়ও নয়। কাপড় দিয়েই প্রস্তুত হতে পারে স্যানিটারি প্যাড। ফলে, কাপড়কে মূলধন করেই প্রাথমিকভাবে এগিয়েছিল গুঞ্জ। যদিও বর্তমানে তার কাজের পরিসর অনেক বিস্তৃত। এমনকি, গুঞ্জ কাউকে 'ত্রাণ' করা বা 'রিলিফ' দেওয়ায় বিশ্বাসীও নয়। সে কাজের মাধ্যমেই মানুষকে তার প্রাপ্য পৌঁছাতে চায়।
পাশাপাশি উঠে আসে অন্য একটি প্রসঙ্গও। সামাজিক কাজকর্ম অনেকসময়ই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়। ফলে, হতাশা জন্মায় যুবক-যুবতীদের মধ্যে। কীভাবে কাটানো যায় তা? অংশু গুপ্তা তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দিশা দেখালেন তরুণ প্রজন্মকে। সত্যিই তো, যে-কোনো ভালো কাজেই বাধা আসবে। তা কাটিয়ে এগনোর নামই জীবন।
সব মিলিয়ে, এভাবেই অফবিট সিসিউ-তে প্রান্তকথার উদ্যোগে এ রাজ্যের উদ্যোগী তরুণেরা এক অপূর্ব সন্ধ্যার সাক্ষী হয়ে থাকল গতকাল।
ছবিঋণ - বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor