ভুয়ো খবর প্রচার বা ‘ফেক নিউজ’, আজকের দিনে এক বহুল আলোচিত বিষয়। কিন্তু যদি বলা হয়, এর জন্ম আসলে সভ্যতার একেবারে শুরুতে? অবাক হবেন নিশ্চই! তাহলে ২৭০০ বছরের প্রাচীন একটি বাস রিলিফ ভাস্কর্যের কথাই ধরা যাক। এত বছর ধরে যে মূর্তি মানুষকে ভুল তথ্য পরিবেশন করে আসছে। আসিরিয়ান সভ্যতার কিংবদন্তি রাজা আসুরবনীপালের সিংহ শিকারের একটি দৃশ্য নিয়েই মূর্তিটি তৈরি। আপাতভাবে তাতে বোঝার কিছুই নেই। দেখা যাচ্ছে একটি সিংহকে রাজা তাঁর বল্লমের সাহায্যে হত্যা করছেন। অনেকেই ভাবতে পারেন, কোনো যুদ্ধজয়ের পর ফিরে এসে সিংহ হত্যা করছেন তিনি। রোমান ও আসিরিয় সভ্যতায় এমন রেওয়াজ ছিল।
কিন্তু আসলে যে বিষয়টি তা নয়, সেই সন্দেহ তৈরি করে সমকালীন কিছু সরকারি নথি। সেখান থেকেই ঐতিহাসিকরা জানতে পারেন, রাজা আসুরবনীপালের মৃত্যু হয়েছিল সিংহের আক্রমণেই। না, মূর্তিতে তাঁর সাফল্যের দৃশ্য দেখানো হলেও বাস্তবের রাজা সিংহের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে প্রথম একদল প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আর এই সময় প্রথমেই খুঁটিয়ে দেখা হয় মূর্তির আরও নানা দিক। প্রত্নতাত্ত্বিকদের সব প্রশ্নের উত্তর শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় একটি অলঙ্কারের মধ্যে। রাজার কানে ঝুলতে থাকা একটি কুণ্ডল।
হঠাৎ দেখলে মনে হয়, রাজাদের এমন অলঙ্কার থাকতেই পারে। আকারে তা মানুষের কানের চেয়ে বেশ কিছুটা বড়ো। আর তার মধ্যেই আছে পাঁচটি তিরের ফলার মতো অংশ। ভাস্কর এই কুণ্ডলটি তৈরি করেছেন অতি যত্নে। প্রতিটি ফলার তীক্ষ্ণতা এতদিন পরেও স্পষ্ট বোঝা যায়। আর সন্দেহ তৈরি হয় সেখানেই। এটি নিশ্চই রাজার প্রকৃত অলঙ্কারের সজ্জা নয়। বরং এর ভিতর দিয়ে কোনো সাংকেতিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। অবশেষে আসিরিয়ান ধর্মবিশ্বাসের নানা অধ্যায় খুঁজে মেলে সেই সাংকেতিক বার্তার হদিশ। ১৯৬০ সাল নাগাদ ঐতিহাসিকরা একমত হন, রাজা আসুরবনীপাল আসলে সিংহের আক্রমণেই প্রাণ হারিয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, এই দৃশ্য আসলে আরোপিত। তবে বাস্তবের সঙ্গে তার একেবারে সম্পর্ক নেই, এমন নয়। আসিরিয়া তখন রীতিমতো সিংহের উপদ্রবে বিপর্যস্ত। প্রত্যেক পুরুষ সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। মানুষ ছাড়াও শিকার বলতে গবাদি পশু তো আছেই। আর রাজাদের অন্যতম বড়ো সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করা হত সিংহের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করা। রাজা আসুরবনীপালও সেজন্যই সিংহের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরাজয়কে ঢেকে ফেলা হয়েছে এক রূপকের সাহায্যে। আর ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওই কুণ্ডলে। সেখানে পাঁচটি তিরের ফলার উপস্থিতি আসলে রাজার বারবার ফিরে আসার কথাই বলে। অর্থাৎ সিংহের হাতে মৃত্যু হলেও রাজা আবার সংগ্রামের জন্য আসবেন। তবে এর মধ্যে একধরণের আত্মতৃপ্তির অনুভূতি থাকলেও সত্যতা নেই কিছুই।
আরও পড়ুন
শামুকের ভিতর হাতজোড় সৈন্য, ব্রিটেনে আবিষ্কৃত ‘মধ্যযুগীয় মিম’-মূর্তি
প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজ সামান্য তথ্য থেকেই একটা ইতিহাসের বিশ্লেষণ করা। কিন্তু সেই কাজ মাঝে মাঝে সত্যিই কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে প্রাচীন যুগে রাজাদের স্তুতি করার জন্য এত ধরণের রূপকের ব্যবহার করা হত, যা আজ বোঝা বেশ কঠিন। আর এভাবেই ২৭০০ বছর ধরে ভুল তথ্য দিয়ে আসছে ‘দ্য লায়ন হান্ট অফ আসুরবনীপাল’ নামে পরিচিত ভাস্কর্যটি।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
৪১ বছর বয়সে এক ম্যাচে ৫ উইকেট, টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে বিশ্বরেকর্ড সান্থা মূর্তির