নাগাল্যান্ডের অখ্যাত একটি গ্রাম চেসেজু। সবুজে ঘেরা, ছোট্ট একটা জায়গা, কেউ নামটুকুও জানে না। আর ১৯৪৪ সালে তো আরওই দুর্গম ছিল এটি। তবুও এই অখ্যাত গ্রামটির ওপর দিয়েই বারবার পাক খাচ্ছে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সেই দিকে তাকিয়ে আছেন ভেজু সুয়োরো এবং তাঁর বন্ধুরা। গ্রামের সামান্য বাসিন্দা তাঁরা; যুদ্ধের খবর সেরকম জানেন না। তাই এরকম ঘটনা দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। তাঁদের পাশেই বসে আছেন আরও একজন। সুদর্শন, পরনে সামরিক পোশাক, চোখে চশমা। আর সেই চশমার পেছনের চোখ দুটি সোজা তাকিয়ে আছে সামনে। অবাক হয়ে গেলেন ভেজু সুয়োরো। সবাই যেখানে যুদ্ধবিমানের আওয়াজ শুনে ভয় কাঁপছে, সেখানে এই মানুষটির মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই! নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে এমনই…
এই তো, কয়েকদিন আগেই চলে গেছে তাঁর জন্মদিন। নেতাজি বন্দনায় এখনও মেতে আছে গোটা ভারত। আর হবে নাই বা কেন? তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী বলে কথা! সুভাষকে ভোলা কি এতই সোজা! তবে এর মধ্যেই তাঁকে আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছেন ভেজু সুয়োরো। আজ ৯৩ বছরের বৃদ্ধ তিনি; কিন্তু স্মৃতি বেইমানি করেনি তাঁর সঙ্গে। মনে পড়ে যাচ্ছে আজ থেকে প্রায় ৭৭ বছর আগের কথা। ভেজু সুয়োরো তখন কিশোর। নাগাল্যান্ডের অখ্যাত চেসেজু গ্রামেই হাজির হয়েছিলেন নেতাজি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈনিকদের সঙ্গে দীর্ঘ দুই মাস ওই গ্রামে কাটিয়েছিলেন, ওখানকার গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিলেন। আর ওই পর্যায়ে সুভাষের স্থানীয় সহকারী ও বন্ধু ছিলেন বছর ১৬-র ভেজু সুয়োরো।
ততদিনে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতজয়ের শপথ নিয়ে নিয়েছে। লক্ষ্য একটাই- দিল্লি চলো। ব্রিটিশদের শেকল থেকে ভারতকে মুক্ত করতেই হবে। বার্মা (অধুনা মায়ানমার) হয়ে নেতাজি ঢুকেছেন ভারতের সীমানায়। আর সেইসূত্রেই চলে এসেছেন নাগাল্যান্ডে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও যে চলছে। এমন প্রেক্ষাপটেই ভেজু সুয়োরোর সঙ্গে আলাপ হল ‘সুদর্শন, বন্ধুবৎসল’ নেতাজির। সঙ্গে পাঞ্জাবী এবং বাঙালি সৈনিকরা। ঘোড়ায় চড়ে নেতাজি গ্রামে ঢুকলেন; সঙ্গে তলোয়ার, বোমা এবং পিস্তল। সেদিন থেকেই তিনি হয়ে গেলেন ‘সাহা’ অর্থাৎ সাহেব…
প্রথম দর্শনে ভেজু’র মনে হল, ইনি বোধহয় জাপানের কোনো সেনানায়ক। তাই প্রথমে নেতাজি ছিলেন ‘জাপানের রাজা’। পরে অবশ্য এই ধারণা ভেঙে যায়। আরে, সুভাষ যে তাঁদেরই একজন! আজাদ হিন্দ বাহিনী যুদ্ধে জিতে গেলে কী কী করবে, সেইসব গ্রামবাসীদের বোঝাতে লাগলেন নেতাজি। এই গ্রামেরও অনেক উন্নয়ন করা হবে, আশ্বাস দিলেন তিনি। তবে তার আগে এই যুদ্ধ জিততে সাহায্য করতে হবে। এই গ্রামে আশ্রয় দিতে হবে, এবং যাতে এই মানুষগুলোর একটু পেট ভরে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই রাজি হয়ে গেলেন এক মুহূর্তে। ব্রিটিশকে তাড়াতে যে হবেই!
পাঠক, আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, কথাবার্তা চলত কেমন করে? সুভাষচন্দ্র বসু তো নাগাল্যান্ডের ওই গ্রামবাসীদের ভাষা জানতেন না। আর ভেজু সুয়োরোরাও অন্য কোনো ভাষা জানতেন না। তাহলে? উপায় একটাই, সংকেত। ভাষা আর ব্যবধান হয়ে রইল না এখানে। আজও বৃদ্ধ ভেজু সুয়োরোর মনে পড়ে, যতবারই খাবার এনে দিয়েছেন, নেতাজি থালা বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে। ওই থালা থেকে ভেজু প্রথমে খেতেন, তারপর নেতাজি। আজও সেই সমস্ত দিনের কথা ছবির মতো মনে পড়ে তাঁর…
১৯৪৪-র এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত নেতাজি এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীরা ছিলেন নাগাল্যান্ডের চেসেজু গ্রামে। সুভাষ তখন ব্রিটিশদের ত্রাস। যে করেই হোক, তাঁকে দমন করতে হবে। সেই সূত্রেই দুটো যুদ্ধবিমান উড়ে এসেছিল নাগাল্যান্ডে। ভেজু সুয়োরোরা রীতিমতো ভয় পেয়ে যান। শেষমেশ তিনি গ্রাম থেকে চলে যান। আর অদ্ভুত ব্যাপার, ভেজু সুয়োরো যেদিন গ্রাম ছাড়েন, সেদিনই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গ্রাম ঘেরাও করে। যুদ্ধবিমান তো দেখে নিয়েছে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবস্থান। ব্যস, শুরু হল যুদ্ধ…
আরও পড়ুন
‘আমার কারোর থেকে উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন নেই’, হিটলারকে জবাব সুভাষচন্দ্রের
পরের দিন আরও কয়েকজনকে নিয়ে চুপিসারে চেসেজু গ্রামে প্রবেশ করেন ভেজু সুয়োরো। না, নেতাজিরা নেই। গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন। আর গোটা জায়গাটা রীতিমতো বিধ্বস্ত। নেতাজির থাকার জন্য একটি বাড়ি ছিল, আরেকটিতে ছিলেন আজাদ হিন্দের সেনারা। নেতাজির বাড়িটি রীতিমতো বিধ্বস্ত, প্রায় কিছুই নেই সেখানে। কোনো মৃতদেহও নেই; কিন্তু রক্তের দাগ পাওয়া গিয়েছিল। আর দ্বিতীয় বাড়িতে দুজন সৈনিকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাহলে বাকিরা? বোধহয় অন্য জায়গায় চলে গেছেন…
ভেজু সুয়োরোর মনে পড়ল, নেতাজি যে বাড়িটায় থাকতেন, তার পেছনে দুটো পুকুর ছিল। একটি পুকুর কেবল নেতাজিই ব্যবহার করতেন। সেখানে গিয়ে পুকুর থেকে জল তুলে খেতে গিয়ে দেখেন, কেমন একটা গন্ধ। ব্যাপারটা কী? এরকমটা তো আগে ছিল না! গন্ধটা কেমন পচা পচা। পরে দেখা গেল, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের হত্যা করে এই পুকুরে ফেলে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। পচা দেহ ভেসে উঠতেই আসল কারণটা বোঝা গেল। আর একটা অখ্যাত গ্রামও, কেমন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের মঞ্চ হয়ে গেল…
বহু বছর পর এই ঘটনাই সামনে নিয়ে এলেন ভেজু সুয়োরো। বয়স হয়েছে তাঁর, দেখেছেন চেসেজু গ্রামকে বদলে যেতে। দেখেছেন দেশের স্বাধীনতাও। শুধু নেতাজিরই আর দেখা পেলেন না। কিন্তু গল্পগুলোকে হারিয়ে যেতে দেননি তিনি। সময় নিয়ে তুলে আনলেন সবার সামনে। আর তাঁর জন্যই নতুন এক অধ্যায় জানতে পারল দেশবাসী।
আরও পড়ুন
সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য সঙ্গত নয় ‘বন্দে মাতরম’, রবীন্দ্রনাথই বলে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রকে
ঋণ - 93-year-old Naga man reminisces of times spent with Netaji, Smita Bhattacharyya, North East Now
Powered by Froala Editor