বয়স ৯৩ বছর। বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে শরীরে। কখনও হাত কাঁপে। কখনও আবার ঝাপসা হয়ে যায় চোখ। কৈশোর থেকেই যে হ্যালুসিয়েশন তাঁর সঙ্গী। তবে এতকিছুর পরেও আঁকা ছাড়েননি তিনি। সায়কায়েট্রিক হাসপাতালে থেকেও, নিয়মিত রং-তুলি নিয়ে ক্যানভাসের সঙ্গে বসে পড়েন তিনি। বিভীষিকাময় স্মৃতি, দুঃখ, যন্ত্রণাকে উগড়ে দেন ক্যানভাসে।
ইয়ায়োই কুসামা (Yayoi Kusama)। এই কিংবদন্তি জাপানি (Japanese) শিল্পীর নাম শুনেছেন অনেকেই। বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত চিত্রকর্মের তালিকার শীর্ষস্থানেই রয়েছেন জাপানের এই শিল্পী। এমনকি বর্তমান বিশ্বের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পীদের মধ্যে প্রবীণতম জীবিত শিল্পী তিনিই। তাঁর হাত ধরেই একটা সময় বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল পোলকা-ডট চিত্রকলা এবং কুমড়োর ভাস্কর্য বা পামকিন স্কাল্পচার। তবে যে জিনিসটা অনেকেরই অজানা কিংবা স্বল্পচর্চিত তা হল, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে তাঁর নিরন্তর লড়াই।
এই গল্পের শুরু তিরিশের দশক থেকে। ১৯২৯ সালে জাপানের মাৎসুমোতো শহরে জন্ম কুসামার। ছোটোবেলা থেকেই গার্হস্থ্য হিংসা দেখেই বড়ো হয়েছেন কুসামা। বাবা-মায়ের ঝগড়ার আঁচে রোজই পুড়তে হত তাঁকে। আরেকটু বড়ো হতে যৌন হিংসারও সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর জাপানের একটি পোশাক তৈরির কারখানায় চাকরি নেন তিনি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর। সেনাবাহিনীর জামা এবং জুতো সেলাই করার কাজ। তাতে সংসার চলে না মোটেই। তবে দেশের জন্য বাধ্যতামূলকভাবেই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হত কুসামাকে। মাথার উপর দিয়ে ঘন ঘন উড়ে যেন মার্কিন যুদ্ধবিমান। এমনকি কয়েক মিটার দূরে বোমা পড়তেও দেখেছেন তিনি।
এসকল ঘটনাই ধীরে ধীরে ট্রমার মধ্যে ঠেলে দেয় কিংবদন্তি শিল্পীকে। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতেই রং-তুলিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কৈশোরের হ্যালুসিনেশন কিংবা ট্রমাকেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন ক্যানভাসে। তাঁর চিত্রশিল্পের বিষয় হয়ে উঠেছিল জীবন, মৃত্যু, যুদ্ধ, রক্তপাত কিংবা মুক্তি।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পেশাদার শিল্পী হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখেন তিনি। তবে সহজ ছিল না লড়াইটা। প্রথমত তিনি জাপানি। ফলে জাতিগত বিদ্বেষ তো ছিলই। তার ওপর আবার মহিলা। লিঙ্গ সাম্যের জন্যে দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন তিনি। ভাঙতে চেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল। সাফল্যও পেয়েছেন। তা না হলেও, সর্বাধিক বিক্রিত চিত্রকর্মের তালিকার শীর্ষস্থানে পৌঁছানো যায় নাকি?
তবে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কুসামা মূলত কাজ শুরু করেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। মানসিক চাপ, ট্রমা, পিটিএসডির মতো বিষয়কেই ফটোজেনিক রূপ দেন তিনি। শুধু ক্যানভাসই নয়, ভাস্কর্যেও এই বিষয়গুলিকে ফুটিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে জাপানে ফিরে আসার পর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর লেখা একাধিক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে জাপানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
সত্তর দশকের শেষ দিকে জাপানের এক মানসিক হাসপাতালে স্বেচ্ছায় ভর্তি হন তিনি। বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সেই সায়কায়েট্রিক হাসপাতালেরই বাসিন্দা। অবশ্য কাজ থেমে নেই। আজও প্রতিদিনই শিল্পসাধনা করে চলেছেন নবতিপর শিল্পী। বিশ্বের কোনো-না-কোনো প্রান্তে লেগেই রয়েছে তাঁর প্রদর্শনী। মূলত মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ছবিই প্রদর্শনীতে পাঠান কুসামা।
সম্প্রতি হংকং-এর ‘এম+’ মিউজিয়ামেই আয়োজিত হল তাঁর এক একক প্রদর্শনীর। ‘ইয়ায়োই কুসামা : ১৯৪৫ টু নাউ’-খ্যাত এই চিত্র-প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছে তাঁর আঁকা ২০০টিরও বেশি ছবি এবং শতাধিক ভাস্কর্য। শেষ বয়সে এসে কুসামা আজও মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর না দিলে বিশ্বে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা স্থাপন করা অসম্ভব। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিশ্বজুড়ে অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে মানসিক স্বাস্থ্য। অথচ, তা নিয়ে বিগত সাত দশক আগেই কাজ শুরু করেছিলেন এক চিত্রশিল্পী— তা ভাবলেও বেশ অবাক হতে হয় বৈকি…
Powered by Froala Editor