কয়েকদিন আগের কথা। নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ এবং জলের অধিকারকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল আফগানিস্তান ও ইরান। ঝলসে উঠেছিল আগ্নেয়াস্ত্র। প্রাণ হারিয়েছিলেন বেশ কিছু মানুষ। এই সংঘাতকে বিশ্বের প্রথম ‘জল-যুদ্ধ’ (Water War) হিসাবে অভিহিত করেছিলেন বিশ্বের কূটনীতিবিদদের একাংশ। আগামীদিনে এই ‘জল-যুদ্ধ’ অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠতে চলেছে গোটা বিশ্বজুড়ে, বিশেষত আফ্রিকায়। ২০৫০ সালের মধ্যেই জলসংকট নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে আফ্রিকার (Africa) ৯২ কোটি মানুষ। এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক সমীক্ষা।
‘দ্য কনভারসেশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই সমীক্ষাটির নেতৃত্বে ছিলেন আমস্টারডামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষক সোফি ডি ব্রুইন। তাছাড়াও এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন আইএইচই ডেলফট, ইউট্রেচ বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াগেনিঞ্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। কিন্তু গবেষকদের এ-ধরনের দাবির কারণ কী? হঠাৎ কেন মাথাচাড়া দিচ্ছে একটা গোটা মহাদেশের মানুষদের জল-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা?
পিছিয়ে যেতে হবে দেড় দশক। নীল নদের ওপর গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য বিশেষ ঘোষণা করেছিল ইথিওপিয়া। আর এই প্রকল্প ঘিরেই বিতর্কে জড়ায় মিশর এবং সুদান। নীল আফ্রিকার দীর্ঘতম নদী। নীল প্রবাহিত হয় উগান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান ও মিশরের ওপর দিয়ে। কিন্তু নীলের শাখানদীগুলি ইথিওপিয়ার অতিক্রম করে মেশে নীল নদে। ফলে, ইথিওপিয়ায় দৈত্যাকার বাঁধ নির্মিত হলে নীল নদের প্রবাহ প্রভাবিত হতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা মিশর ও সুদানের। কারণ, এই দুই দেশে পানীয় এবং সেচ প্রকল্পে ব্যবহৃত জলের প্রায় ৯৭ শতাংশ আসে নীল থেকে।
দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চললেও এই সমস্যার কোনো সমাধানই খুঁজে পায়নি আফ্রিকার তিন দেশ। অন্যদিকে গত বছর থেকেই এই বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করেছে ইথিওপিয়ার প্রশাসন। সবমিলিয়ে ক্রমশ বেড়ে চলেছে তিন দেশের উত্তেজনা। পরবর্তীতে যা যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেই ধারণা গবেষকদের।
তবে এখানেই শেষ নয়। আফ্রিকার বেশিরভাগ নদী অববাহিকাই কোনো নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে অবস্থিত নয়। বরং, কোনো নদীর অধিকার দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বণ্টিত। ভৌগোলিক মানচিত্র অনুযায়ী, আফ্রিকার ৬৬টি দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা রয়েছে। যার মধ্যে নীল নদের অববাহিকা ছাড়াও আছে হর্ন অফ আফ্রিকার জুবা-শেবেল এবং লেক তুরকানা অববাহিকা। উল্লেখ্য, এই অববাহিকার জলের অধিকার এবং বণ্টনের হার নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থার ওপর। আর সেটিই হয়ে উঠতে চলেছে সংঘাতের কারণ।
একদিকে যেমন দ্রুত জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে আফ্রিকায়, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমশ বদলাচ্ছে আফ্রিকার বৃষ্টিরেখা। দেখা দিচ্ছে চরম জলাভাব। ফলে নদীর ওপর নির্ভরতা বাড়ছে মানুষের। অন্যদিকে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে শক্তি সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছল দেশগুলি। পরবর্তীতে এই ঘটনাই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে বলেই অনুমান গবেষকদের।
গবেষকদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার জনসংখ্যা ছুঁতে পারে ৪০০ কোটির গণ্ডি। যার মধ্যে এক পঞ্চমাংশ বা ৯২ কোটি মানুষ তীব্র জল-সংকটের শিকার হবেন। তাঁরাই মূলত জড়িয়ে পড়বেন সংঘাতে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার পর, সংখ্যাটা ৫৩.৬ কোটিতে নেমে আসলেও সম্পূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব-- মনে করা হচ্ছে এমনটাই। সবমিলিয়ে জলকে কেন্দ্র করেই যেন বৃহত্তর এক যুদ্ধের প্রমাদ গুনছে আফ্রিকা।
Powered by Froala Editor