আচ্ছা, আমাদের সবার তো নিজস্ব পছন্দের রং আছে। মাসেরও কি কোনো রং থাকে? সবার থাকে কিনা জানা নেই, অন্তত জুন মাসের আছে। জুনের রং রামধনুর। সাতটি রং খেলে যায় প্রকৃতির বুকে। আমরাও তো সেই প্রকৃতিরই অংশ; আমাদের শরীর-মন সবটা জুড়েই তার উপস্থিতি। নিজেদের মতো বাঁচার ইচ্ছা আমাদের সবার। নিজীদের মতো সঙ্গী নির্বাচনেরও স্বাধীনতা আছে। সর্বোপরি, খোলা আকাশে ওড়ার স্পর্ধাটুকুও। বেড়াজাল, লোহার শিকল ঘিরে ধরলেও কেউ হার মানবে না। জুন মাসের রামধনু পতাকা সেই হার না মানারই কথা বলে। নিজেদের অস্তিত্বটাকে সগর্বে উচ্চারণ করার, সেই মতো বাঁচার শক্তি দেয়। ‘প্রাইড মান্থ’ তো আর এমনি এমনি বলা হয় না!
সমকামী মানুষ, এলজিবিটি মানুষদের স্বাধীনতার উদযাপনের মাস বলা হলেও, এর সামগ্রিক চিত্রটা আরও বৃহৎ। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার যে অধিকার, তাকেই আরও একবার জানিয়ে দেওয়ার জন্যই জড়ো হন বিশ্বের সমস্ত মানুষরা। শুধু এলজিবিটি মানুষরাই নন, সমস্ত বেড়া মুছে দিয়ে সমস্ত পরিচয় সরিয়ে রেখে একটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়— ‘মানুষ’! আর আমাদের বাঁচার অধিকার আছে। সেই ১৯৬৯ সালের ২৮ জুনের কথা ভাবুন। যেদিন নিউ ইয়র্কের পুলিশ হঠাৎ করেই ঢুকে পড়েছিল স্টোনওয়াল ইনে। যার পরিচয় একটি ‘গে বার’ হিসেবে। সেই সময় জুয়া, ড্রাগ মাফিয়া, খুনের পাশাপাশি অপরাধী হিসেবে দেখা হত যৌনকর্মী এবং সমকামীদেরও। বিনা বিচারে গ্রেফতার এবং হাসপাতালেও পাঠানো হত ওই মানুষদের। এই ঘৃণ্য নিয়মের অন্যতম ‘ভিক্টিম’ কিংবদন্তি বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং।
যাই হোক, ১৯৬৯ সালের জুন মাসেও পুলিশ সেই অদ্ভুত ‘নিয়মেই’ রেইড করেছিল স্টোনওয়াল ইনে। কিন্তু এবার তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেমে এল। মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরলেন সেখানে উপস্থিত মানুষেরা। কিন্তু ‘রাষ্ট্র কি কখনও মুক্তাঞ্চল বরদাস্ত করে’! প্রতিবাদ শুরু হল আমেরিকায়। তারপর সেই খবর পেয়ে পরেরদিন, অর্থাৎ ২৯ জুন থেকে ছয়দিন ধরে প্রতিবাদ চলে। শুরু হয় ‘প্রাইড মান্থ’। তখন থেকেই জুন মাসের রং বদলে গেল রামধনুতে। মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরলেন বিশ্বের যাবতীয় সমকামী মানুষরা।
এই বছর, ২০২০’র প্রাইড মান্থে উঠে এল আরও একটি চমকপ্রদ ঘটনা। আমেরিকার কলোরাডোর প্রাক্তন কাউন্সিলর এবং সুপারভাইজার কেনেথ ফেল্ট। এখন তাঁর বয়স ৯০ বছর। এইবছরের প্রাইড মান্থের সময়ই তিনি নিজেকে সমকামী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই উপলব্ধি আজকের নয়। কেনেথ যখন ১২ বছর বয়সী এক কিশোর, তখন থেকেই এই ব্যাপারটি বুঝতে পারেন তিনি। কিন্তু সমাজ, পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে কখনও স্বীকার করেননি বা নিজের আপনজনদেরও বলতে পারেননি। আজ, এই ৯০ বছর বয়সে এসে মুক্তির স্বাদ পেতে চাইছেন তিনি। উড়তে চাইছেন রামধনুর আকাশে। তাই সদর্পে নিজের সমকামী সত্তাকে প্রকাশ করলেন তিনি। আর এই ঘটনাই প্রাই মান্থকে এক অন্য মুহূর্ত দিল। বাঁচার আনন্দ বেড়ে গেল কয়েকগুণ। পর্দা সরিয়ে এইভাবেই যেন মুক্তির আনন্দে মেতে ওঠে মানুষ— প্রাইড মান্থের ভেতর দিয়ে এমন কথাই বারবার উঠে আসে…
Powered by Froala Editor