সপ্তাহ খানেক আগের কথা। ১৮ তারিখে হঠাৎ-ই ইউরোপের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা উয়েফার বিরুদ্ধে কার্যত ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করে বসেছিল ১২টি সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ইউরোপীয় ক্লাব। তার মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বদলে গিয়েছিল সুপার লিগের ভাগ্য। পরিস্থিতির চাপে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় ৯টি ক্লাব। তবে এখনও অনড় রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং জুভেন্তাস। বাতি নিভে এলেও সুপার লিগ ঘিরে এখনও নাটকীয়তা চলছে ইউরোপ জুড়েই। আর সেই বিতর্ককে জাইয়ে রাখছেন রিয়াল মাদ্রিদ ও সুপার লিগের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ।
ফুটবলের এই বাণিজ্যিকরণের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের ফুটবলপ্রেমীরা। পরিস্থিতিকে রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি মোড় ঘুরিয়ে দেন তাঁরাই। উয়েফা-প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার সেফেরিনের ভাষায়, ‘দর্শকরাই নিদান দিয়ে দিয়েছেন ইউরোপীয় ফুটবলের ভাগ্য ঠিক কোন দিকে যাবে।’ তাতে ভুল নেই এতটুকু। দর্শকরাই বুঝিয়ে দিলেন এখনও মৃত্যু হয়নি আবেগের।
বৃহত্তর এই প্রতিবাদের পরিচলনটা শুরু হয়েছিল ব্রিটেন থেকেই। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন হাজার হাজার দর্শক। টিকিট থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের দিন চেলসি স্টেডিয়ামের বাইরে অবস্থান নেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুটবলপ্রেমী। আগুনটা অন্যান্য ফুটবল জায়েন্টগুলির সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি খুব বেশি। আর সেই চাপেই কার্যত পিছিয়ে আসে ব্রিটেনের ‘বিগ সিক্স’। সেইসঙ্গে দুই মিলান-সহ সুপার লিগ থেকে নিজেদের প্রত্যাখ্যান করে নেয় অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদও।
সুপার লিগ হোক বা না হোক— প্রতিষ্ঠাতা সবগুলো ক্লাবের বিরুদ্ধেই যে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা জানিয়েছিলেন উয়েফা প্রেসিডেন্ট। পাশে দাঁড়িয়েছিল ফিফাও। সমর্থকদের ‘রায়’-এ ৯টি ক্লাবের সরে দাঁড়ানোকে উয়েফা খানিকটা মার্জনার চোখেই দেখছে। লঘু করা হবে তাদের শাস্তির মাত্রা। তবে একথা পরিষ্কার, নিস্তার পাচ্ছে না বাকি তিনটি ক্লাব। বেশ জোর গলাতেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফিফা এবং উয়েফা অনুমোদন ছাড়া কোনো টুর্নামেন্ট খেললে জায়গা হবে না জাতীয় লিগ এবং কাপগুলিতে। এমনকি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে নিষিদ্ধতাও চাপতে পারে ক্লাবগুলির ওপরে। অন্যদিকে পরিস্থিতি বুঝে ভোল পাল্টেছেন সুপার লিগের মূল স্পন্সর জেপি ব্যাঙ্ক-ও। এখন তাঁর মুখেও সম্প্রীতির সুর।
আরও পড়ুন
ইউরোপিয় সুপার লিগ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে, জাতীয় দল থেকেও নিষিদ্ধ হবেন খেলোয়াড়রা!
তবে এত কিছুর পরেও অনড় রিয়াল, বার্সা এবং জুভেন্তাস। সুপার লিগ আয়োজনের ব্যাপারে এখনও আত্মবিশ্বাসী পেরেজ। উয়েফাকে ‘জব্দ’ করতে ক্রমাগত হুংকার ছেড়েই চলেছেন তিনি। আয়োজক পদ থেকে সরে দাঁড়ানো ৯টি ক্লাবের যে সহজেই নিস্তার নেই, সে বিষয়েই সম্প্রতি সাংবাদিক সম্মেলনে জানান পেরেজ। প্রকাশ্যে আনেন, চুক্তির সময়ে কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবগুলির ওপর। ফলে চাইলেই সরে যেতে পারবে না ক্লাবগুলি। প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে। জরিমানা করা হতে পারে মোটা অঙ্কের টাকা।
আরও পড়ুন
জুভেন্তাস হোক বা বার্সেলোনা, ‘বোঝা’ মেসি-রোনাল্ডোর মতো তারকারাই
তিন ফুটবল জায়েন্টের এখনও পর্যন্ত অনড় থাকার কারণ ঠিক এটাই। ইতিমধ্যেই দেনার দায়ে ডুবে রয়েছে বার্সেলোনা এবং জুভেন্তাস। অন্যদিকে রিয়াল-কর্তা পেরেজ চিরকালই ছুটেছেন অর্থের পিছনে। সে রোনাল্ডোকে বিক্রি করা হোক কিংবা লুই ফিগোর ঘটনা— ফুটবলের থেকে তাঁর কাছে বার বার প্রাধান্য পেয়ে এসেছে ব্যবসায়িক দিকটাই। আর সেই কারণেই এখনও পর্যন্ত বিরোধ জারি রাখা।
সংকট পেরিয়ে আসার পরেও পেরেজের এই অবস্থানের জন্যই এখনও দোলাচলে ইউরোপীয় ফুটবল। যদি সত্যিই আইনি পদক্ষেপ নেয় সুপার লিগ কর্তৃপক্ষ, তবে ঠিক কোন পথ বেছে নেবে বাকি ক্লাবগুলো সেটাই দেখার। সম্প্রতি পেরেজ পরিষ্কার করে দেন, সুপার লিগ না হলেও আগামীতে আয়োজিত হতে চলেছে অন্য কোনো স্বতন্ত্র লিগ। অন্যদিকে এই স্বার্থপরতার জেরে, বিশ্ব ফুটবল আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে হারাতে পারে তার তিন মণিমুক্তোকে। ইউরোপীয় ফুটবলের সেই ললাটলিখনের বিষয়ে এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না বিশ্লেষকরাও…
Powered by Froala Editor