যতদূর দেখা যায় ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল, ধূ-ধূ প্রান্তর। বসতির লেশমাত্র নেই। এমন জনমানবহীন পান্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ড্রাইভারের সিটে বসে এক বৃদ্ধ। তাঁর পাশে আরও দুই তরুণ-তরুণী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল অ্যাম্বুলেন্সে কোনো রোগীই নেই। কোথায় যাচ্ছে এই অ্যাম্বুলেন্স (Ambulance)?
জন শ্যাকেলটন (John Shackleton)। হ্যাঁ, ড্রাইভারের সিটে বসা সেই বৃদ্ধই নর্থ ইয়র্কশায়ারের ৮৩ বছর বয়সী এই বাসিন্দা। ইউরোপের প্রান্তিক যেসব অঞ্চলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিকাঠামো নেই, সেখানে এই অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য তাঁর। বলতে আপত্তি নেই, তাঁর এই কর্মকাণ্ড বেশ বিচিত্রও বটে।
নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহর। সেখানেই রয়েছে ইউরোপের সেকেন্ড হ্যান্ড সামগ্রী বিক্রির বৃহত্তম বাজার। সাশ্রয়ীও বটে। সেখানে গিয়ে বছর তিন-চারেকের পুরনো অ্যাম্বুলেন্স কেনেন জন। ইংল্যান্ডে সেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফিরে, তার তিন-চতুর্থাংশ ভরে ফেলেন বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং চিকিৎসা সামগ্রীতে। তারপর পাড়ি জমান ইউরোপের প্রান্তিক কোনো অঞ্চলে। অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়াটুকুই তাঁর কাজ। সেটা করেই আবার বিমানে করে ফিরে আসা নিজের শহরে।
না, শুধু ইংল্যান্ড নয়। ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইতালি, কাজাখস্তান, চেক প্রজাতন্ত্র-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন এই পরিষেবা। এখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৪৮টি অ্যাম্বুলেন্স দান করেছেন তিনি। হ্যাঁ, দান করেছেন। অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সামগ্রী কেনা থেকে শুরু করে তা পৌঁছে দেওয়া— জন সবটাই করেন নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে। অন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিংবা প্রশাসনের বিন্দুমাত্র সাহায্য নেন না তিনি। কিন্তু এমন একটি প্রকল্প এককভাবে চালিয়ে যাওয়া তো মুখের কতা নয়। কোথা থেকে আসে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ?
আরও পড়ুন
৫ বছরের প্রতিবন্ধী কিশোরের জন্য বাসস্টপ নির্মাণ, মানবিকতার নজির পড়ুয়াদের
সারা বছর ধরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন জন। বলতে গেলে ছোটোখাটো একটি অরণ্য রয়েছে তাঁর। সেখানে রেডউড, ফ্লয়েডউডের মতো মূল্যবান কাঠের বৃক্ষ ‘চাষ’ করেন করেন তিনি। বছরের শেষে বিক্রি করেন সেই কাঠের গুঁড়ি। পাশাপাশি বছরভর ফেন্সিং, লনিং-এর মতো নানান কাজ করেন ইয়র্কশায়ারে। সংসার চালানোর খরচটুকু বাদ দিয়ে উপার্জনের বাকিটা তিনি জমিয়ে রাখেন এই স্বেচ্ছাসেবী প্রকল্পের তহবিল হিসাবে। তা দিয়েই চলে এই কর্মযজ্ঞ। এমনকি করোনা পরিস্থিতিতেও চ্ছেদ পড়েনি এই রীতিতে।
আরও পড়ুন
আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে রাজি, মানবিক সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের
অল্প বয়স থেকেই সমাজকর্মী হিসাবে মাঠে নেমেছিলেন জন এবং তাঁর স্ত্রী। প্রাথমিকভাবে ইয়র্কশায়ারেরই একটি অনাথ আশ্রমের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন শ্যাকেলটন দম্পতি। তবে চার দশক আগের একটি ঘটনাই বদলে দেয় তাঁর জীবনকে। চোখের সামনে আশ্রমেরই এক ছোট্ট শিশুকে চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে দেখেন জন। সেই ঘটনার পরেই চিকিৎসাভাবের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নামেন শ্যাকেলটন দম্পতি। শুরু হয় ইউরোপের প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কর্মযজ্ঞ।
আরও পড়ুন
কোভিড-যোদ্ধাদের মনোবল বাড়াতে নাচ সার্জেনদের, মানবিক দৃশ্য ঢাকায়
৮৩ বছর বয়সেও সেই লড়াই ছাড়েননি জন। তবে বেড়েছে প্রতিকূলতা। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী আক্রান্ত অ্যালজাইমার রোগে। তাঁকে দেখভাল করা দায়িত্বও জনের কাঁধেই। এখন তাঁর অভিযানের সঙ্গী বলতে দুই নাতি-নাতনি। কিন্তু জনের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের আদৌ কি কেউ এই দায়িত্ব নেবেন? সেই চিন্তাই কুড়ে কুড়ে খায় ইয়র্কশায়ারের বৃদ্ধ সমাজকর্মীকে। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে তাঁর এই উদ্যোগ এবং মানসিকতা মানবিকতার এক জ্বলন্ত নজির…
Powered by Froala Editor