ছোট্ট সাজানো কাঠের বাড়ি। আর তাকে ঘিরেই আস্ত একটা অরণ্য। কী নেই সেখানে? সিডার, জুনিপার, পাইন, বট, ইউক্যালিপটাস, ফিসাস, ম্যাপল, চেরি— একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে সবকিছু। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল এই গোটা অরণ্যের আয়তন মাত্র কয়েক হাজার স্কোয়ার ফিট। এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, একা হাতেই এই অরণ্য তৈরি করেছেন বিশ্ববিখ্যাত বনসাই মাস্টার মাসাহিকো কিমুরা।
বনসাই কথাটার সঙ্গে পরিচিত সকলেই। মূলত বড়ো বৃক্ষের মিনিয়েচারই হল বনসাই। এই বনসাইয়ের জন্মস্থান চিন হলেও, তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায় জাপান। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরেই সেখানে রয়েছে বনসাই-এর চল। জাপানের প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িই সাজানো হয় এই বামন বৃক্ষ দিয়ে। তবে মাসাহিকোর কৃতিত্ব আলাদা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে বুঝতে হবে ‘বনসাই’ কথাটির অর্থ। জাপানি ভাষায় ‘বন’ কথার মানে পাত্র। আর ‘সেকি’ কথার অর্থ বৃক্ষরোপণ। অর্থাৎ, ছোট্ট টবে বৃক্ষরোপণই হল বনসাই। তবে প্রথাগত এই ধারণাটাকেই বদলে দিয়েছেন মাসাহিকো। টব বা কোনো পাত্র নয়, বরং তাঁর তৈরি বনসাইয়ের বাগান গড়ে উঠেছে পরিত্যক্ত কাঠের ওপর। জঙ্গল থেকে বিভিন্ন শুকনো গাছের কাণ্ড এবং বাকল সংগ্রহ করে, তার ওপরেই তিনি রোপণ করেন বনসাইয়ের চারা। তার সঙ্গে মিশে থাকে তাঁর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যও। সব মিলিয়ে গোটা দৃশ্যটাই হয়ে ওঠে ম্যাজিকাল। আর সেই কারণেই স্থানীয়দের কাছে ‘ম্যাজিকাল টেকনিশিয়ান’ আখ্যাও পেয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি তাঁর শিল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট হল, তা ব্যালেন্সিং। সূক্ষ্ম সরু তারের কিংবা দণ্ডের ওপরে ভর করে দাঁড়িয়ে এক বা একাধিক বনসাই। দেখলে মনে হবে, এই নিখুঁত ব্যালেন্সিং যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তত্ত্বকেই।
আরও পড়ুন
গাছের পাতা থেকেই স্যানিটাইজার! আশ্চর্য দাবি উত্তরবঙ্গের গ্রামের!
১৯৩০ সালে জাপানের সাইতামায় জন্ম মাসাহিকোর। বনসাই শিল্পী হিসাবে তিনি কাজ করা শুরু করেছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। তখন অবশ্য বনসাই মাস্টার মোটোসুক হামানোর একটি বাগানে সহকারী হিসাবে কাজ করতেন তিনি। এগারো বছর সেই বাগানে কাজ করার পর নিজেই খুলে ফেলেন বনসাইয়ের ব্যবসা। বনসাই তৈরির কারিগরি ততদিনে রপ্ত হয়ে গেছে তাঁর। এবার নিজের উদ্ভাবনীকে মিশিয়ে দিলেন সেই রীতির সঙ্গে। আর তাতেই যেন ‘ম্যাজিক’ খেলে গেল।
আরও পড়ুন
দুই সহস্রাধিক গাছের অভিভাবক তিনি, বার্ধক্যও দমাতে পারেনি পুরুলিয়ার দুখু মাঝি-কে
এখনও পর্যন্ত একাধিক ‘গ্র্যাভিটি ডিফাইং’ বনসাই অরণ্য তৈরি করেছেন মাসাহিকো। কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে সেসব। তবে বছর কুড়ি আগের তৈরি প্রথম মিনিয়েচার অরণ্যটি নিজের কাছে সযত্নে রেখে দিয়েছেন তিনি। নিজের হাতেই প্রতিদিন সেই তার পরিচর্যা করেন মাসাহিকো। নতুন নতুন বিস্ময়কর উদ্ভাবনী সংযোজন করেন সেই অরণ্যে। বর্তমানে তাঁর এই মিনিয়েচার অরণ্যই জাপানের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। দর্শনার্থীদের অনুরোধে একপ্রকার নিজের বাড়িকেই মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলেছেন মাসাহিকো। এই বিস্ময়কর দৃশ্য চাক্ষুষ না করলে, বিশ্বাস করার উপায় নেই। কী ভাবছেন জাপানে গেলে একবার ঘুরে আসবেন নাকি মাসাহিকোর এই অরণ্যে? এটুকুই নিশ্চিন্তে বলা যায়, একবার ঢুকে পড়লে হতাশ হওয়ার জায়গা নেই কোনো…
আরও পড়ুন
১৫৫টি গাছের ঔষধি গুণ নখদর্পণে, বিনামূল্যেই চিকিৎসা করেন অশীতিপর ভাষাসৈনিক
Powered by Froala Editor