গ্রেট নিকোবর। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে দক্ষিণতম দ্বীপ এটিই। দক্ষিণ আন্দামানের থেকে আয়তনে বড়ো হলেও মাত্র হাজার সাতেক মানুষের বসবাস এই দ্বীপে। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই চেহারা বদলে যেতে চলেছে গ্রেট নিকোবরের (Great Nicobar)। সম্প্রতি এই দ্বীপে বিমানবন্দর, সামরিক কার্যালয়, শক্তি উৎপাদনকেন্দ্র এবং টাউনশিপ তৈরির কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র সরকার। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অনুমান, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সাড়ে ৬ লক্ষ মানুষের বাসস্থান হয়ে উঠবে এই দ্বীপ।
তবে সরকারের এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক সবুজ সংকেত দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন পরিবেশবিদদের একাংশ। গ্রেট নিকোবরের উন্নয়নে ভারত জাতীয় নিরাপত্তা, সামরিক অবস্থান, পর্যটন ও বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভবান হবে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। বিশেষত পূর্ব ভারত মহসাগরীয় অঞ্চলে চিনের গতিবিধির ওপর নজরদারি রাখতে বিশেষভাবে সুবিধা হবে ভারতীয় নৌসেনার। তবে এই প্রকল্পের জন্য বড়ো অঙ্কের খেসারৎ দিতে হবে পরিবেশকে।
গত ৩০ মার্চ পরিবেশ মন্ত্রকের দপ্তরে জমা দেওয়া কেন্দ্র সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই প্রকল্পের জন্য কাটা পড়বে সাড়ে ৮ লক্ষ গাছ। অর্থাৎ, সাফ হয়ে যাবে আন্দামান-নিকোবরের রেইনফরেস্টের একটা বড়ো অংশশ। তাছাড়াও মুছে যাবে ১২-২০ হেক্টর অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত করা অঞ্চলটি গ্যালাথিয়া বে জাতীয় উদ্যান এবং ক্যাম্পবেল জাতীয় উদ্যানের থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সংশ্লিষ্ট দুটি ন্যাশনাল পার্কই অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল বলেই দাবি পরিবেশবিদ ও গবেষকদের। ফলে, সেখানকার বন্যপ্রাণী ও বাস্তুতন্ত্রের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে এই উন্নয়ন, আশঙ্কা তাঁদের।
বৃহত্তম সামুদ্রিক কচ্ছপ লেদারব্যাক টার্টেলের আবাসস্থল গ্রেট নিকোবর দ্বীপ। সেইসঙ্গে মেগাপড, ম্যাকক পাখি, বিরল প্রজাতির পেঁচা-সহ একাধিক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ও উদ্ভদের বসবাস এই দ্বীপে। প্রকল্পের নীল-নকশা অনুযায়ী গ্রেট নিকোবরের মেগাপডের ৫১টি বাসস্থানের মধ্যে ৩০টিই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে আগামীদিনে। তাছাড়াও এই দ্বীপে বসবাস শম্পেন এবং নিকোবরিস উপজাতির মানুষদের। হঠাৎ অরণ্যের পরিমাণ হ্রাস পেলে, তাঁরাও কি নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবেন এই উন্নয়নের দুনিয়ার সঙ্গে? এইসকল প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে বার বার।
জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং সেলিম আলি সেন্টার ফর অর্নিথোলজি অ্যান্ড ন্যাচরাল হিস্ট্রি—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। এই প্রকল্পের জন্য যাতে ন্যূনতম প্রভাব পড়ে গ্রেট নিকোবর দ্বীপে— সেই বিষয়টিরই মূল্যায়ন করবেন তাঁরা। ম্যাকক কিংবা প্যাঁচার বসবাস যে সকল গাছে, সেগুলিকে জিওট্যাগ করে চিহ্নিত করা হবে আলাদা করে। নিশ্চিত করা হবে তাদের সুরক্ষা। কিন্তু একবারে কি সাড়ে ৮ লক্ষ গাছের মৃত্যুর ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে প্রকৃতি? জানা নেই উত্তর। হয়তো কোনোদিনই এই ক্ষত পূরণ হবে না, তেমনটারই আভাস দিচ্ছেন গবেষকরা…
Powered by Froala Editor