গ্রিক দেবী এথেনা ও রোমান দেবী মির্নাভার সঙ্গে একসাথে অবস্থান করে একটা করে পেঁচা। গ্রিসে ও রোমে এথেনা ও মির্নাভা দুজনেই পূজিত হন জ্ঞান ও বুদ্ধির দেবী হিসাবে। এই দুই দেবীকে দেখলেই আমাদের প্রথমেই মনে আসে দেবী লক্ষ্মীর কথা, যে আমাদের ঘরে বেদিতে আলো আছেন উৎসবের অঙ্গ হিসাবে। বাঙালি তাই তাকে স্থান দিয়েছে নিজের হৃদয়ে, গানে, সিনেমাতে। 'এসো মা লক্ষ্মী/বসো ঘরে/আমায় এই ঘরে থাকো আলো করে।' - এ গান যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের গান। আদি অনন্তকাল দেবী লক্ষ্মী বিষ্ণু বা নারায়ণের স্ত্রী হিসাবেই পূজিত হন, পূজিত ধন-সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী চিরায়ত দেবী হিসাবে। তামিল ভাষাতে মা লক্ষ্মীকে বলা হয় আলাই মগল, যার মানে হল সমুদ্রজাত কন্যা, অর্থাৎ সমুদ্র মন্থন করে যে দেবীর জন্ম হয়েছে। তাই অনেকে মা লক্ষ্মীকে সিন্ধুজাও বলেন। বিষ্ণুপুরাণে লক্ষ্মীকে বলা হয়েছে ভৃগুপত্নী। বহু পুরাণে মহালক্ষ্মীকে বলা হয়েছে দুর্গার অদ্বিতীয় শক্তিরূপা। মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে মহালক্ষ্মীর একটি সতীপীঠ আছে, যেখানে দুর্গা আর মহালক্ষ্মীকে একই রূপে পূজা করা হয়। ভূ-ভারতে মা লক্ষ্মীর আটটি রূপকে পূজা করা হয় যত্নের সঙ্গে। শাস্ত্রমতে এই এটটি রূপই রয়েছে তাঁর। অবশ্য পরবর্তীকালে বাঙালি তাঁদের 'মা'কে নিজেদের মতো করে দ্বিভুজা বানিয়ে নিয়েছে। যাইহোক, যে আটটি রূপ আমাদের চিরপরিচিত, যা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি -
১. বিদ্যালক্ষ্মী – মা লক্ষ্মীর বিদ্যালক্ষ্মী রূপটি চারহাতবিশিষ্ট। তিনি পদ্মাসনে উপবিষ্ট থাকেন। তার এক হাতে অভয় মুদ্রা, অন্য হাতে বরদা মুদ্রা এবং বাকি দুটি হাতে থাকে দুটি পদ্মফুল। জ্ঞানী ও বিদ্যানদের কাছে বিদ্যাও একটা ধনস্বরূপ, বিদ্যালক্ষ্মী দেবী তার ভক্তদের সেই বিদ্যাধন আশীর্বাদ করেন।
২. গজলক্ষ্মী – মা লক্ষ্মী এই রূপটি সমুদ্রমন্থনকালে আবির্ভূত হয়। পদ্মাসনে উপবিষ্ট এই দেবীরও দুই হাতে দুটি পদ্মফুল থাকে এবং অন্য দুই হাতে অভয় ও বরদা মুদ্রা। পদ্মাসনে বসে থাকা এই দেবীর দুই দিকে দুটি হাতি শুঁড় দিয়ে দেবীকে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। দুই গজ শুঁড় বিশিষ্ট অবস্থায় দেবী উপবিষ্ট থাকেন বলেই তিনি গজলক্ষ্মী।
৩. ধান্যলক্ষ্মী – অখণ্ড বাংলা ও ভারতের শস্যের দেবী হলেন ধান্যলক্ষ্মী। এই দেবী আট হাত বিশিষ্ট এবং পরনে চিরসবুজ বস্ত্র, যা শস্যের সবুজের পরিবাহক। এই আট হাতে তিনি ধরে থাকেন আখ, কলা, ধানের গুচ্ছ, গদা এবং অভয় ও বরদা মুদ্রা। তিনি তার ভক্তদের আশীর্বাদ হিসাবে কৃষিধন দান করেন।
৪. বিজয়লক্ষ্মী – পরনে রক্তবর্ণা বস্ত্রপরিহিত মা লক্ষ্মীর অন্যরূপা এই দেবীও আট হাত বিশিষ্ট। এই আট হাতে চক্র, শঙ্খ, তলোয়ার, পাশ, ঢাল, পদ্ম এবং অভয় মূদ্রা ও বরদা মুদ্রা থাকে। জীবনের যে-কোনও অশুভ পরিস্থিতিতে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিজয়ালক্ষ্মী দেবীর উপাসনা করা হয়।
৫. ধৈর্য্যলক্ষ্মী – মা লক্ষ্মীর এই ধৈর্যলক্ষ্মী দেবীও অষ্টভুজা। চক্র,শঙ্খ, ধনুক, তির, ত্রিশূল, তলোয়ার, পুস্তক এবং অভয় মুদ্রা ও বরদা মুদ্রা বিশিষ্ট আটহাতে সেজে থাকে দেবী ধৈর্য্যলক্ষ্মী। শক্তি ও সাহসের দেবী হিসাবে অনেকে একে বীরলক্ষ্মীও বলে ডাকেন।
৬. ধনলক্ষ্মী – ষড়ভুজা এই দেবীর লালবস্ত্র পরিধান করে থাকেন। ছয় হাতে শঙ্খ, চক্র, কলসি, তির-ধনুক, পদ্ম ও এক হাতে থাকে অভয় মুদ্রা। অভয় মুদ্রিত হাত থেকে স্বর্ণমুদ্রা গড়িয়ে পড়ছে এটাও অনেক পটচিত্র বা সরাচিত্রে দেখা যায়। এই দেবী তার ভক্তদের ধন-সম্পদ ও জাগতিক সমস্ত সুখ দান করেন।
৭. সন্তানলক্ষ্মী – সন্তান কামনা ও ধন সম্পদ লাভের জন্য অনেকেই এই দেবীর পূজা করেন। মা লক্ষ্মীর এই রূপটিও ছয় হাত বিশিষ্ট। ঢাল, তলোয়ার, দুটি হাতে কলসি ও অভয় মুদ্রা এবং একটি হাতে পদ্মফুল ধরা একটি মানবশিশু থাকে।
৮. আদিলক্ষ্মী – আদিলক্ষ্মী চারহাত বিশিষ্ট দেবী। এই দেবী চার হাতে পদ্ম, সাদা পতাকা, অভয় মুদ্রা ও বরদা মুদ্রা থাকে। আদিলক্ষ্মীকে বলা হয় বিষ্ণুর চালিকা শক্তি। মূলত তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী হিসাবেই পূজিত হন। তার একটি নাম ইন্দিরা, অন্য নাম শ্রী বা শ্রীদেবী। কোথাও কোথাও আদিলক্ষ্মী রমা নামেও ডাকা হয়।
বাংলাতে মা লক্ষ্মীর সঙ্গে সমানভাবে পূজিত হয় তার বাহন পেঁচাটিও। তবে পেঁচাকে অনেকে অলক্ষ্মীর প্রতীক হিসাবেও চিহ্নিত করেন। ইউরোপ ও আমেরিকাতে পেঁচাকে মৃত্যুর দূত হিসাবে দেখা হয়, তাই অশুভ প্রাণী হিসাবে মানা হয় একে। মূলত পেঁচার নিশাচরী স্বভাবের জন্য এই বাংলাতেও ভুতুম পেঁচাকে মৃত্যুদূত বলা হয়। তবে যারা পেঁচা শুভ দূত হিসাবে মানে তাদের যুক্তি হল মা লক্ষ্মীর বাহন হিসাবে পেঁচা হল সতর্কীকরণের প্রতীক। যেমন বাড়িতে ধনসম্পদ বৃদ্ধি হলে অশুভ শক্তি বা পাপও বাড়িতে প্রবেশ করে, পেঁচা তা সংকেত দেয় মানুষকে, যাতে মানুষ অবগত হতে পারে সেই অশুভ শক্তি বা পাপ সম্পর্কে। আবার অন্য যুক্তি হল - মানুষ যখন ঘুমায় তখন পেঁচা জেগে থাকে মানুষের ধনসম্পদের পাহারা দেয়, অর্থাৎ ধনসম্পদকে বাড়াতে হয় সবার আড়ালে, সন্তর্পণে। অন্যদিকে শস্যের দেবী মা লক্ষ্মীর শস্য কেটে দেয় ইঁদুর জাতীয় প্রাণীগুলো, তাতে মানুষের ক্ষতি হয়। নিশাচর পেঁচা ইঁদুর শিকার করে মানুষকে রক্ষা করে।
এভাবেই অনন্তকাল ধরে ভালোয়-মন্দে গৃহস্থের ঘরে হয়ে চলেছে লক্ষ্মীপুজো। প্রতি বৃহস্পতিবার নারায়ণের বামে বসলেও, বছরে এই একদিন, কোজাগরী পূর্ণিমার তিথিতে সাড়ম্বরে পূজিত হন তিনি। ফলাফল অবশ্য ধোঁয়াশাতেই ঢাকা। তবে ভক্তিমার্গে সেসব আর কেই বা ভাবে...