কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ। হাতে ধরা ছাতা। রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে চলেছেন এক বৃদ্ধ। এমন দৃশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য যে-কারোর। কোথায় যাচ্ছেন এই প্রবীণা? কেন-ই বা খালি পায়ে হাঁটছেন তিনি? আপনার কাছে এই দৃশ্য বিস্ময়কর হলেও, কেরলের (Kerala) কাসারগোড় শহরের মানুষের কাছে অতিপরিচিত এই দৃশ্য। কেননা, বিগত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিক্ষাদান করেন ৬৫ বছর বয়সি এই ‘যুবতী’।
কে ভি নারায়ণী (K V Narayani)। অবশ্য স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ‘নারায়ণী টিচারও’ (Narayani Teacher) নামেই। মালায়লম, সংস্কৃত, হিন্দি এবং ইংরাজি— মূলত এই চারটি বিষয়ই পড়ান প্রবীণ শিক্ষিকা। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা রয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থীর তালিকায়।
নারায়ণীর এই লড়াই শুরু হয় ভোরবেলা থেকেই। সাড়ে ৪টেয় বিছানা ছাড়ার পর ঘরের কাজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন ‘নারায়ণী টিচার’। হাঁটতে হাঁটতে সাড়ে ৬টার মধ্যেই পৌঁছে যান ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি। ঘণ্টা দুয়েক পড়িয়ে, তারপর আবার অন্য ছাত্রের বাড়ির দিকে হাঁটা লাগান তিনি। শিক্ষাদানের এই কর্মযজ্ঞ চলে রাত পর্যন্ত। সবমিলিয়ে দিনে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন কেরলের প্রবীণা। আর খালি পায়ে হাঁটা? প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকতে গিয়ে, সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, কেরলের কাসারগোড়ের এই জনপ্রিয় শিক্ষিকা কোনোদিন পা দেননি কলেজে। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি। ১৯৭১ সালের কথা। দশম শ্রেণি পাশ করার পর আর্থিক অনটনের জন্য পড়াশোনায় রেশ টানতে হয়েছিল তাঁকে। পরিবারের হাল ধরতে শিক্ষকতা শুরু করেন নারায়ণী। তখন তাঁর ১৫ বছর বয়স মাত্র। তবে কোনোদিনও কোনো স্কুলে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেননি তিনি। বরং, টিউশনকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁর পেশা হিসাবে। বিগত পাঁচ দশক ধরে সসেই পেশা আঁকড়েই বেঁচে রয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, শিক্ষাই সমাজ তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তাই সামান্যই গুরুদক্ষিণা নেন তিনি।
কাসারগোড়ের চেরুভাতুর একটি ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে থাকেন নারায়ণী। টিউশন ফি দিয়েই শয্যাশায়ী স্বামীর চিকিৎসা চলে, চলে সংসারের খরচও। তবে ধীরে ধীরে বয়সের ছাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছেন তিনিও। কমেছে চোখের জ্যোতি। শরীরও আগের থেকে দুর্বল। তবে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই লড়াই চালিয়ে যাবেন, সে ব্যাপারে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ ‘নারায়ণী টিচার’…
Powered by Froala Editor