কাকতালীয়! হবেও বা। স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকানোর মহারাজা যেদিন বিসিসিআই-এর মসনদে বসছেন, সেদিন তাঁর শহর কলকাতাও যেন বাউণ্ডারির ওপারে সব সমালোচনা ছুড়ে ফেলে বলে ফেলল, ‘বাপি বাড়ি যা’। এ-ও তো ছক্কা। খোদ কলকাতার, এবং তা-ও নোবেলে। হ্যাঁ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরলে ছ-জন নোবেলজয়ীর সঙ্গেই মিশে থাকল কল্লোলিনী।
আরও পড়ুন
তিন বাঙালি অর্থনীতিবিদের নোবেল প্রাপ্তি, বিশ্ব অর্থনীতিকে আজও দিশা দেখাচ্ছে বাংলা?
বাঙালির জন্য, বাংলার জন্য এ বড়ো কম গর্বের কথা নয়! একদা এই মুলুকের বাসিন্দাদেরই তো দেখা হয়েছিল নেহাত খাটো চোখে। ঐতরেয় আরণ্যকে শীর্ণকায় কৃষ্ণবর্ণ বঙ্গবাসীদের পাখির মতো বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল। এমনকি সংস্কৃত স্মৃতি ও সাহিত্যে যে আর্য শব্দটিকে শিষ্ট ও ভদ্র হিসেবে পরিগণিত করা হয়, এই বঙ্গের অধিবাসীদের কপালে তা জোটেনি। বদলে অনার্য বলেই সম্বোধন করা হয়েছে। এবং, এই অ-শিষ্ট মানুষের বসবাসের স্থান ব্রাহ্মণবাসের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এই ঘৃণা সুপ্রাচীন ও সুবিদিত। বাংলার ইতিহাসের গোড়ায় ফিরলে দেখব, এই ঘৃণা যত জোরদার হয়েছে বাংলায় তত খেলে বেড়িয়েছে স্বাধীন চিন্তার হাওয়া। সে-যুগে ব্রাহ্মণরা সে-সব পত্রপাঠ প্রত্যখ্যান করেছে, কারণ বৈদিক ধর্মের বিপক্ষবাদী স্বাধীন যে-কোনো মতবাদ এই বাংলার জল-হাওয়াতেই ক্রমাগত পুষ্টিলাভ করেছে। ফলে, যত কটাক্ষই থাক না কেন, চিন্তার সেই স্বাধীন পরিসর বাংলাকে মেধাচর্চায় এগিয়ে দিয়েছে বরাবর। আজও সেই ঘৃণার বয়ান বা হেয় করা প্রবৃত্তি কমেনি। গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে আছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বাঙালিরই একাংশের স্বার্থসিদ্ধির অভীপ্সা। কিন্তু তাতে বাঙালির বিজয়রথ আটকায় না। বরং সকল মারের মুখের উপর দিয়েই সে আবার ফুল তুলে আনে। এবং যে উপেক্ষাতন্ত্র বাঙালিকে সরিয়ে রাখতে অভ্যস্ত, তাকেই বারবার বার্তা দিয়ে বাঙালি যেন বলে চলেছে যে,- বাংলাকে, বাঙালিকে অস্বীকার করা যাবে না।
কাকে অস্বীকার করা সম্ভব? রবীন্দ্রনাথকে? হ্যাঁ, তাঁর আদর্শ কতটা গ্রহণ করা হচ্ছে বা হচ্ছে না, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকবে অবশ্যই। কিন্তু জাতীয় সংগীতের রচয়িতাকে দেশ অস্বীকার করবে কী করে! আসুন এক ঝলকে স্মরণ করে নেওয়া যাক, কীভাবে ছয় নোবেলের সঙ্গে জড়িয়ে রইল কলকাতা –
১। সাল ১৯১৩। ইউরোপ মহাদেশের বাইরে অর্থাৎ প্রাচ্য দেশীয়দের মধ্যে প্রথম কেউ নোবেল পেলেন। সাহিত্যেও এশিয়া মহাদেশে এল প্রথম নোবেল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির রবি। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে। ১৫ নভেম্বর, সন্ধের দিকে খবর এসেছিল, কবি নোবেল পেয়েছেন। টাউন হলে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়ার একটা আয়োজন হয়েইছিল। তার মধ্যেই এই অপ্রত্যাশিত খবর। প্রায় ৫০০ লোক কলকাতা থেকে বোলপুরে গিয়ে কবিকে সংবর্ধনা জানিয়ে এসেছিলেন।
২। সি ভি রামন। এশিয়ায় প্রথম বিজ্ঞানে নোবেল আনলেন তিনি, ১৯৩০ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা করেছেন। এ-শহরেই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে গবেষণা করেছেন কৃতী এই পদার্থবিদ।
৩। ১৯৭৯-তে শান্তির নোবেলের সঙ্গেও জুড়ে থাকল কলকাতা। এবার নোবেল পেলেন মাদার টেরিজা। জন্মসূত্রে বিদেশি হলেও তাঁর সাধনভূমি তো এই কল্লোলিনীই। এই শহরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
৪। অমর্ত্য সেন নোবেল পেলেন অর্থনীতিতে, ১৯৯৮ সালে। শান্তিনিকেতনে জন্ম, প্রেসিডেন্সির ছাত্র অমর্ত্য আর-একবার বাঙালির তথা এ-শহরে মেধার রোশনাই এনেছিলেন।
৫। সাম্প্রতিক আলোর ছটা এনেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও কলকাতার মানুষ। প্রেসিডেন্সির ছাত্র, উচ্চশিক্ষা জেএনইউ-তে। ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে-ই বাকি দুই গবেষকের সঙ্গে নোবেল পেলেন তিনি।
৬। আরও এক নোবেল জয়ের সঙ্গে বাঙালির যোগ আছে। ১৯০২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন রোনাল্ড রস। তিনি অবশ্যই ভারতীয় নন। কিন্তু ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার কাজটি করেছিলেন এই কলকাতাতেই।
অর্থাৎ, বাঙালির মেধাচর্চা ও স্বীকৃতি পাওয়ার ধারা অব্যাহত। নিঃসন্দেহে তা গর্বের কথা। যে বাঙালিকে সুমহান বৈদিক যুগ থেকে হেয় করে আসা হয়েছে, সেই বাঙালিই যখন বিশ্বের দরবারে দেশকে বারবার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে ও বসাচ্ছে, তখন গর্ব না হয়ে উপায় কী! কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বিবেচ্য যে, সামগ্রিক ঘৃণার শক্তি যেন এই গৌরবের ইতিহাসকে অতিক্রম না করে যায়। কারণ বাঙালির প্রবল হীনমন্যতা। গৌরবের আখ্যান যত ম্লান হয়, বাঙালি তত খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। বাংলায় এটা নেই, সেটা নেইয়ের মধ্যে সে হারিয়ে ফেলে বাংলার প্রতি তার ভালোবাসা। সেই ছন্নছাড়া বাঙালির সামনে যখন আবার একটা গৌরবের মাইলস্টোন আসে, তখন সে তা নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না। কার্যত দেখা যায় বিতন্ডার জেরে হারিয়ে গেছে স্বীকৃতির গুরুত্ব। শঙ্কা সেখানেই। বরং এই গৌরবের মুহূর্ত বাঙালিকে স্মরণ করাক যে, তার ইতিহাস কখনও গৌরববিচ্ছিন্ন নয়। ফলে বিশ্বাস হারানো নয়, বাঙালি হওয়াকে উদযাপনের ভিতরই লুকিয়ে আছে প্রকৃত বাঙালিয়ানা। সেটাই বাঙালির এক হওয়ার শক্তি। মেধাচর্চার এই দারুণ ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালি যেন পুনরাবিষ্কার করে তার একতার শক্তিকে, সেই প্রাচীন কাল থেকে শত ঘৃণা, আক্রমণ সত্ত্বেও যা তাকে ভেঙে পড়তে শেখায়নি, বরং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেই সাহস জুগিয়েছে।