‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ তখন শেষের পথে। তবে সাবধানের মার নেই। আমেরিকার নৌবাহিনীর হাইড্রোফোন যন্ত্রগুলি তখনও সক্রিয়। যাদের কাজ সমুদ্রের গভীরের বিভিন্ন শব্দতরঙ্গের রূপ দেখে রাশিয়ান সাবমেরিনের গতিবিধি শনাক্ত করা। ১৯৮৯ সাল নাগাদ ম্যাসাচুসেটসের একটি গবেষণাকেন্দ্রের রেডারে ধরা পড়ে এক আশ্চর্য শব্দ। যার কম্পাঙ্ক ৫২ হার্জ। তাহলে কি রাশিয়ান সাবমেরিনগুলি এখনও সক্রিয়? ধেয়ে আসছে অনিবার্য বিপদ? কিন্তু সেগুলির কম্পাঙ্ক তো ২০-৩০ হার্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে? গবেষণায় চমকে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। পাওয়া যায় এক তিমির সন্ধান। সম্ভবত, পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমি...
১৯৯২ সালে আমেরিকার নৌবাহিনীর গবেষণায় নিশ্চিত হয় এই প্রাণীর অস্তিত্ব। ম্যাসাচুসেটসের Woods Hole Oceanographic Institution-এর গবেষক উইলিয়াম ওয়াটকিনসন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি নিজের কানকে। সাধারণত তিমির ডাকের কম্পাঙ্ক হয় ১৫ থেকে ২৫ হার্জের মধ্যে। সেখানে এই প্রাণীটির শব্দের কম্পাঙ্ক ৫২ হার্জ! তাঁর বিশ্বাস ছিল এ নিশ্চয়ই তিমির শব্দ। কারণ, ফিন তিমি ও নীল তিমি-রা যে অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে, সেই অঞ্চল থেকেই আসছে শব্দটি। আর সেই কারণেই তার নাম রাখা হয় ’৫২-হার্জ তিমি’ (52-hertz Whale)।
প্রতি বছর আগস্ট মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে পাওয়া যেত তার আগমনবার্তা। ডিসেম্বরে তীব্র হত সেই শব্দ। ক্রমে ফেব্রুয়ারিতে হারিয়ে যেত আবার কোনো অজানার উদ্দেশ্যে। তবে, শুধুমাত্র একটি তিমির থেকেই আসে শব্দটি। অর্থাৎ, তার আর কোনো সঙ্গীসাথী নেই। সম্পূর্ণ একা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তার ডাকের কম্পাঙ্ক অন্য তিমিরা শুনতে পায় না। কিংবা শুনতে পেলেও তার বক্তব্য বুঝতে পারে না। ওয়াটকিনসন অবশ্য অন্য জুড়ি খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছিলেন।
আরও পড়ুন
সামুদ্রে খনন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে তিমি-ডলফিনদের, জানাল সাম্প্রতিক গবেষণা
তাঁর মৃত্যুর পর মেরি অ্যানে ডাহের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। কিছুদিন চাঞ্চল্যের পর বন্ধ থাকে এই সংক্রান্ত গবেষণা। ২০১০-এ প্রফেসর জন হিলডেব্র্যান্ড আবার শুরু করেন কাজ। খুঁজে বের করেন শব্দের উৎস। তবে একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল তাঁদের জন্য। তিমিটির শব্দকম্পাঙ্ক নেমে গেছে ৪৭ হার্জে। সম্ভবত বয়সের কারণেই কমছে তার গলার জোর।
আরও পড়ুন
তিমির পূর্বপুরুষ? জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক প্রাণীর হদিশ দিল জীবাশ্ম
অনেক গবেষকের ধারণা ’৫২-হার্জ’ দুটি তিমি প্রজাতির সংকর। এর গতিবিধি নীল তিমির মতো হলেও, শব্দতরঙ্গের সময়ের ব্যবধান ফিন তিমির মতো। আবার, অনেকের মতে তিমিটি কানে শুনতে পায় না। প্রাণীটি আদৌ তিমি কিনা, সেই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার লোকেরও অভাব নেই। খুব স্বাভাবিক এই প্রশ্নগুলো। কারণ, আজ পর্যন্ত তাকে কেউ চোখে দেখেনি, শুধু তার গলার শব্দ শুনেছে। নেই কোনো ছবিও।
অজানা সমুদ্রের অতলে এক তিমির নিঃসঙ্গ জীবন—কিছুটা এভাবেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘৫২-হার্জ তিমি’। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও-র প্রযোজনায় দু-বছর আগে ‘Loneliest Whale : The search for 52’ ডকুমেন্টারি ছবিটি মুক্তি পায়। তাইওয়ানেও তৈরি হয় একটি সিনেমা। দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএস-এর একটি গানেও আছে এর অনুষঙ্গ। কিন্তু একই সঙ্গে উঠছে মানুষের দৌরাত্ম্যের প্রশ্ন। সমুদ্রের বুকে বড়ো জাহাজের নিয়মিত চলাচল, দূষণ, চোরাশিকারি এগুলো কি আরও একা করে দিচ্ছে তিমিদের? হয়তো সেই কারণেই হারিয়ে যাচ্ছে তিমিদের শব্দতরঙ্গ। ‘৫২-হার্জ’-এর সন্ধান পাওয়া গেলেও মানুষের অদম্য কৌতূহল কি সুখে থাকতে দেবে তাকে?
তবে সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে ‘৫২-হার্জ’ হয়তো একা নয়। আছে তার সঙ্গী। সমুদ্রজুড়ে উচ্চনাদে ডেকে বেড়ায় তাকেই। বলতে চায় ‘কথা’। হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে রয়েছে তার সঙ্গী। লোকচক্ষুর আড়ালে। সত্যি হোক এই গবেষণা। ঘর পাক নিঃসঙ্গ নায়ক। ‘হ্যাপি এন্ডিং’ দেখতে কে না চায়?
Powered by Froala Editor