৫০০০ বছর আগেও মুদ্রার ব্যবহার ছিল প্রাচীন ইউরোপে, দাবি বিজ্ঞানীদের

- এই তরোয়ালটার দাম কত?
- হাতের চারটে কাঁকন, তিনটে পেরেক আর একটা কুড়াল!
- একটু কম হবে না?
- বাঁধা দাম!

না, স্থানকাল কোনোটাই বর্তমান সময়ের নয়। পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৫০০০ বছর! ইউরোপের ব্রোঞ্জ যুগে কয়েন প্রচলিত হওয়ার আগে এভাবেই হয়ত চলত প্রাগৈতিহাসিক দরদাম বা কেনাবেচা। সেইসময়, ধাতুর গোলাকার পাত, পাঁজরের হাড় বা ব্রোঞ্জ ও তামা দিয়ে তৈরি কুঠার ফলকগুলিই ব্যবহার হত সাধারণ মুদ্রা হিসেবে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, ইউরোপের নানা জায়গায় এই বস্তুগুলির ওজন এবং আকার ছিল প্রায় একই। সম্প্রতি মানবসভ্যতার এই প্রাচীনতম আর্থিক ব্যবস্থার কথা সামনে এনেছেন ইউরোপের লেডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। 

খ্রিস্টপূর্ব ২১৫০-১৭০০ সময়কালের ৫০০০টিরও বেশি ধাতবপাত, কুঠার ফলক এবং রিং পরীক্ষা করেছিলেন ডাচ গবেষকরা। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে সংগ্রহ করা নিদর্শনগুলি কপালে ভাঁজ ফেলতে দেরি করেনি তাদের। প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলির মধ্যে রয়েছে বর্তমান দক্ষিণ জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, উত্তর জার্মানি এবং দক্ষিণ স্ক্যান্ডিনেভিয়া। এবং, একটি-দুটি নয়, পাওয়া গেছে কয়েকশো নিদর্শন। 

তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া এই বস্তুগুলি বিভিন্ন সময়ের হওয়া সত্ত্বেও, বিজ্ঞানীদের আশ্চর্য করেছিল এদের সম-আয়তন। আকার এবং ওজনে তারা আশ্চর্যজনকভাবে একরকম ছিল। পরীক্ষিত প্রায় ৭০% রিংয়ের গড় ওজন ছিল প্রায় ১৯৫ গ্রাম। 

কিন্তু স্কেলের ব্যবহার তো ছিল না তখন; তাহলে এটা সম্ভব হল কী করে? 

তাঁদের বিশ্লেষণে, ডাচ গবেষকরা উপলব্ধি মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে ওয়েবার-ফেকনারসূত্র প্রয়োগ করেছিলেন। সহজে বলতে গেলে, উদ্দেশ্যের তীব্রতা মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে কীভাবে তাকে কার্যে রূপান্তরিত করে, এই সূত্র সেটাকেই ব্যাখ্যা করে। ওয়েবার-ফেকনার সূত্র অনুসারে, যখন ওজন প্রায় ২% বৃদ্ধি পায়, কেবল তখনই একটি ওজনের পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। সুতরাং এক কেজি অর্থাৎ ১০০০ গ্রাম ওজনের ধাতব সামগ্রীর জন্য, অন্য কোনো বস্তুকে কম করে ২০ গ্রাম বেশি ভারী হতে হবে।

লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাইকেল কুয়েজ্পারস এবং ক্যাটালিন পোপা তাদের গবেষণায় বলেছেন, এ জাতীয় তুলনামূলক ওজন এবং পরিমাপ ব্যবস্থার বিকাশকে মানব বুদ্ধির 'সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা' বলে উল্লেখ করলেও বাড়াবাড়ি হয় না মোটেই। এবং বাস্তবিক ভাবেই, বস্তুগুলির আকার এবং ওজন এতটাই সমান ছিল যে, সেগুলিকে আর্থিক লেনদেনের 'স্ট্যান্ডার্ড' বা 'মানক' বলে মনে করা অনুচিত নয়। 

আরও পড়ুন
উন্নয়নের নামে প্রাচীন স্থাপত্য ধ্বংস ওড়িশায়, প্রতিবাদে সরব এএসআই

গবেষকদের মতে, এমনকি প্রাগৈতিহাসিক সময়েও লোকেরা বুঝতে পেরেছিল যে, সাধারণ মুদ্রা হিসাবে কাজ করার জন্য বস্তুর একটি 'স্ট্যান্ডার্ড' বা নির্দিষ্ট আকার এবং ওজন থাকতে হবে, যা বিনা দ্বিধায় গৃহীত হবে বিস্তৃত দূরত্বে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, পূর্বপুরুষদের সেই দূরদৰ্শিতাকে কুর্নিশ জানাতেই হয় বৈকি!

Powered by Froala Editor