তুষারে ঢাকা পর্বতে বসে শিশুর মৃতদেহ, বয়স প্রায় ৫০০ বছর

১৯৮৫ সালের কথা। আর্জেন্টিনার অ্যাকনকাগুয়া (Aconcagua) পর্বতের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় পা রেখেছেন একদল অভিযাত্রী। খুবই দুর্গম এই এলাকা। বরফের আস্তরণে মোড়া রয়েছে যুগ যুগ ধরে। আবহাওয়াও অত্যন্ত বিপজ্জনক। আচমকাই ধেয়ে আসে তুষারঝড়। একবার পথ হারালে চিহ্ন পাওয়া যাবে না আর। এই বরফের দেশেই দেহ সমাধিস্থ হয়ে থাকবে কয়েকশো বছর। ঘটেছিল অনেকটা সেরকমই। অভিযাত্রী দলটির সঙ্গে নয়। একটি বালকের সঙ্গে। অভিযাত্রী দলটির চোখে পড়ে সেই বালকের জমাট বাঁধা মমি। সামান্য বিকৃত হলেও পচন ধরেনি একেবারেই। তার বয়স প্রায় পাঁচশো বছর। 

ডাক পড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের। বালকের মৃতদেহ পাঠানো হয় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। আর সেখানেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার অধিবাসীদের রক্ত বইছে তার দেহে। দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক সময়ে ছিল ইনকাদের (Inca) বসবাস। তারপর স্পেনীয় ঔপনিবেশিকদের আক্রমণে কোণঠাসা হতে হতে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তারা। ইনকাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্ম-সংস্কার সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের অসংখ্য কাল্পনিক আখ্যান। এই বালকটিও সেরকমই এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শিকার।

মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র সাত। ইনকাদের মধ্যে দেবতার উদ্দেশ্যে জীবন্ত শিশুদের উৎসর্গ ছিল অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। যাকে বলা হত ‘কাপাকোচা’। রাজাদের সুস্থাস্থ্য, প্রকৃতির বিপদ থেকে রক্ষার জন্য কিংবা ফলনবৃদ্ধির জন্য আয়োজন উৎসর্গিত হত শিশুরা। সম্ভবত সেরকম কোনো কারণেই মাথায় শক্ত কিছুর আঘাতে মৃত্যু হয় বালকটির। তারপর মমি বানিয়ে রেখে আসা হয় উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে। সেখানকার বরফের জন্যই প্রায় ৫০০ ধরে ‘সংরক্ষিত’ অবস্থায় ছিল তার দেহ। পরবর্তীকালেও আবিষ্কৃত হয়েছে ইনকাদের দেহের বহু নমুনা। তার মধ্যে অনেকগুলিই ছিল ‘সংরক্ষিত’। কিন্তু এই বালকের দেহটি সম্ভবত তার প্রাচীনতম নিদর্শন।

তবে এখনও বাকি আছে চমকের। মমির ফুসফুস থেকে মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোমের পরীক্ষায় খোঁজ করা হয় তার পূর্বপুরুষদের। জানা যায়, বালকটির জিনের প্যাটার্নে দক্ষিণ আমেরিকার C1b নামক একটি জাতির ছাপ রয়েছে। আজ থেকে ১৮০০০ বছর আগে প্যালিও-ইন্ডিয়ান সভ্যতার কালে যারা এই পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াত। তবে খুবই দুর্বল সেই সংযোগ। কারণ, C1b-দের মধ্যেও অনেক ছোটো-বড়ো বিভাগ বা গ্রুপ রয়েছে। কয়েক হাজার বছরে তাদের একে অপরের মধ্যে দূরত্ব এসেছে এবং নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছে।

আরও পড়ুন
সুতোয় গিঁট বেঁধেই লেখালিখি করত প্রাচীন ইনকারা!

বালকটির জিনোমের মধ্যে পাওয়া যায় সেরকমই এক স্বতন্ত্র গ্রুপের পরিচয়। যার কোনো অস্তিত্ব এর আগে জানা ছিল না। বিজ্ঞানীরা এই গ্রুপটির নাম দেন C1bi। তাদেরও বয়স ১৪০০০ বছর। মূলত পেরু ও বলিভিয়াতেই ছিল তাদের বসবাস। যদিও আজকের দিনে এই প্রজাতির মানুষের সন্ধান মেলা একেবারেই দুর্লভ। তবে অনুমান যে, অতীতে একসঙ্গেই থাকত তারা। ক্রমে তাদের মধ্যেও বাড়ে দূরত্ব। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল মমিটির আবিষ্কার শুধু ইনকা সভ্যতার গবেষণায় নয়, এক ধাক্কায় দরজা খুলে দেবে আরও অতীতে যাওয়ার। সেই আশা অবশ্য সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি।

আরও পড়ুন
প্রাচীন মায়া সভ্যতার প্রাসাদের হদিশ মিলল মেক্সিকোয়

এর কিছু বছর পরেই, ১৯৯৯-তে চিলি ও আর্জেন্টিনার সীমান্তের আন্দ্রেজ পর্বতমালায় পাওয়া যায় আরও তিনটি শিশুর মমি। এবার শুধু একটি বালক নয়, রয়েছে দুটি নাবালিকাও। তাদেরও বয়স প্রায় পাঁচশো বছর। অভুক্ত রেখে, সারা শরীর বেঁধে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাদের। আগের মমিটির সঙ্গে অবশ্য এদের সরাসরি আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, বীভৎসতার দিক থেকে বোধহয় একই সূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে তারা।

ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হওয়ারও প্রায় ৫০০ বছর হতে চলল। কয়েকটি নিষ্পাপ শিশুকে উৎসর্গ করে কি তারা বাঁচাতে পেরেছিল নিজেদের? স্পেনীয়দের ধারালো অস্ত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাদের অস্তিত্ব। পাহাড়ে-জঙ্গলে পালাতে পালাতে অভুক্ত অবস্থায় গুণতে হয়েছে শেষ দিনগুলি। অদ্ভুতভাবে, ইনকা হত্যাকাণ্ডের মূল স্পেনীয় নায়ক ফ্রান্সিসকো পিজারো খুন হয়েছিলেন নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেই। বাঁচাতে আসেনি কোনো অলৌকিক শক্তিই! সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে কি কোনো অভিশাপ নেমে এসেছিল তাদের উপরে?

Powered by Froala Editor