ইউটিউবে একটি জনপ্রিয় জাপানি গান, ‘ওয়ার্ম নাইটস ইন টোকিও’। তার নিচেই কমেন্ট করেছেন একজন। লিখেছেন, এই গান শুনতে শুনতে তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল ৫০ বছর আগের সেই সময়ের কথা যখন তিনি টোকিওর রাস্তায় গাড়িতে গান চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। দাঁড়ান, এই কমেন্টের আরও একটি অংশ আছে। আর সেটি হল, যিনি কমেন্ট করছেন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর এবং তিনি জন্মেছেন ও বড়ো হয়েছেন আমেরিকায়। কোনোদিন জাপান যাননি।
হ্যাঁ, জাপানি সিটি পপ ঘরানার গানগুলি যেন ঠিক এরকমই জাদু তৈরি করে আজও। একটা সময় আর একটা দেশকে ধরে রেখেছে কথায়, সুরে। মাঝখানে সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বদলেছে গানের শ্রোতাও। একসময় যে গান একেবারেই জাপানিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তার পরিধি আন্তর্জাতিক। কিন্তু সিটি পপ মিউজিককে ঘিরে উন্মাদনা আজও কমেনি। ঠিক এইসব গানের ভিতর দিয়েই যেন জাপানকে চিনতে চাইছেন পাশ্চাত্যের মানুষ। ফুরিয়ে যেতে যেতেও যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেল সিটি পপ মিউজিক।
তবে হঠাৎ কোনো জাপানিকে গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন সিটি পপ মিউজিকের কথা, তাহলে তিনি কিছুই বুঝতে পারবেন না। তাকিয়ে থাকবেন হাঁ করে। কারণ এমন কোনো নাম দিয়ে তাঁরা চিহ্নিত করেননি গানগুলিকে। তাঁদের কাছে এগুলি শুধুই গান। তবে খাঁটি জাপানি গান বলতে যা বোঝায়, তেমন নয় মোটেও। বরং পাশ্চাত্য সুরের প্রভাব স্পষ্ট। মূলত আমেরিকার রক এবং জ্যাজ মিউজিকের প্রভাবেই জাপানে জন্ম নিয়েছিল এই সিটি পপ মিউজিক। আর জাপানের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বৈকি। জাপান তখন পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনীতম দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি কাটিয়ে ৭ ও ৮-এর দশকে নতুন চেহারায় হাজির জাপান। সেখানকার মানুষের তখন অবাধ স্বাধীনতা। লাগামহীন তাঁদের আনন্দ আর তার উদযাপন। এর মধ্যেই নতুন উপহার সোনির ওয়াকম্যান। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে জনপ্রিয় হওয়ার আগেই জাপানের শহরগুলোতে ছেয়ে গিয়েছিল ওয়াকম্যান। আর তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, গাড়ি চালাতে চালাতে বা গাড়ির মধ্যে বসেও অনায়াসে গান শোনা যায় ওয়াকম্যানে।
কিন্তু কী গান শুনবেন? নিশ্চই কোনো ট্র্যাডিশনাল মিউজিক নয়। আর এই বাস্তবতা থেকেই জন্ম নিল সিটি পপ। নতুন কথায় নতুন সুর বসালেন মিকি মাতসুবারার মতো শিল্পীরা। আর এরপর জাপানের অ্যানিমের সূত্রে তা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর নানা দেশে। তবে জাপানি সিটি পপের জনপ্রিয়তা দীর্ঘদিন দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর তার কারণ অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে জাপানি মিউজিক সেভাবে জায়গা পায়নি। তাঁরা সিডির চাহিদা বজায় রাখতেই অনলাইন স্ট্রিমিং-এর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। কিন্তু লকডাউনে সেই নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই শিথিল হয়ে গেল। টিকটক তো বটেই, ইউটিউব এবং স্পটিফাইতেও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকল সিটি পপ মিউজিকের। স্পটিফাইয়ের পরিসংখ্যান বলছে গত ডিসেম্বরে সবচেয়ে ভাইরাল গানটি হল ‘মায়োনাকা নো ডোর / স্টে উইথ মি’। তবে এখনও পর্যন্ত মাত্র গোটা চারেক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে স্পটিফাইতে। আর ইউটিউব অ্যালগরিদমেও সিটি পপ মিউজিককে একভাবে কোণঠাসা করেই রাখা হয়। কিন্তু এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেইসব গান যেন ফিনিক্স পাখি। শেষ হয়ে যাওয়ার ছাই থেকে নতুন করে জন্ম নেয় আবারও।
আরও পড়ুন
নেই কোনো প্রবেশ-প্রস্থান, মুহূর্তদের উপভোগ করতে শেখায় জাপানের এই রেলস্টেশন
Powered by Froala Editor