‘আধুনিক দাসত্ব’-এর শিকার বিশ্বের ৫ কোটি মানুষ!

একসময় গবাদি পশুর মতো হাটেবাজারে বিক্রি হত মানুষ। অর্থের বদলে তাদের তুলে দেওয়া হত সম্ভ্রান্তদের হাতে। অমানবিক অত্যাচার তো চলতই, সেইসঙ্গে বিনাপারিশ্রমিকে বলপূর্বক কাজ করানো হত তাঁদের দিয়ে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর বিশ শতকে নিষিদ্ধ করা হয় এই ঘৃণ্য প্রথাকে। এমনকি ১৯৪৮ সাল থেকে ২৩ আগস্ট দিনটিকে ‘দাসপ্রথা বিলোপ দিবস’ হিসাবেই পালন করে জাতিসংঘ। কিন্তু এতকিছুর পরেও, দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়নি মানুষ। এবার তেমনটাই উঠে এল সাম্প্রতিক সমীক্ষায়।

সাম্প্রতিক সময়ে মহামারী, জলবায়ু সংকট, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সশস্ত্র সংঘাত এবং যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষের জীবন। যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটির বেশি মানুষ ‘আধুনিক দাসত্ব’-এর (Modern Slavery) শিকার। হ্যাঁ, এমনটাই বলছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন (আইএলও), ওয়াকফ্রি এবং ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অফ মাইগ্রেশনের যৌথ রিপোর্ট। কিন্তু এই ‘আধুনিক দাসত্ব’ কী?

মানবাধিকার কর্মীদের মতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে দাসত্বের প্রকৃতি। অর্থের বিনিময়ে সরাসরি মানুষ বিক্রি না হলেও, বহু মানুষকে দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়। বলপূর্বক বিবাহ থেকে শিশুশ্রম কিংবা বাল্যবিবাহ— এইসব কিছুই ‘আধুনিক দাসত্ব’-এর অন্তর্গত। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে অপহরণ করে যৌনকর্মীর পেশাকে বেছে নিতে বাধ্য করা হয়— লিঙ্গভিত্তিক এই সহিংসতাও এক ধরনের দাসত্ব। এমনটাই জানাচ্ছেন আন্তর্জাতিক সংগঠনের কর্মকর্তারা। 

সবমিলিয়ে বিশ্বের মোট ১৮০টি দেশ থেকে বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছিল আইএলও, আইওএম এবং ওয়াকফ্রি। তার ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয় এই রিপোর্ট। অবশ্য ‘আধুনিক দাসত্ব’ নতুন কোনো বিষয় নয়। শেষ ২০১৬ সালে এই বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিল আন্তর্জাতিক লেবার অরগানাইজেশন। সেই রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ রয়েছে এই তালিকায়। তবে বিগত ৫ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। 

এর পিছনে মূলত মহামারীকেই দায়ী করছেন গবেষকরা। মহামারীর কারণে, বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। ফলে, তাদেরকে ন্যূনতম বা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানোও সহজ হয়ে উঠেছে ‘অপরাধী’-দের পক্ষে। অন্যদিকে মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে, তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলিতে এক-ধাক্কায় বেড়েছে স্কুলছুটের সংখ্যাও। বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রমের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে এই একই কারণে। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করেছে জলবায়ু সংকট এবং সশস্ত্র সংঘাত। যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকটের কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে যোগ্য কাজ কিংবা জীবনধারণের রসদ পাচ্ছেন না তাঁদের অধিকাংশই। লঙ্ঘিত হচ্ছে তাঁদের মৌলিক অধিকার। 

পরিসংখ্যানের নিরিখে ‘আধুনিক দাসত্ব'-এর শীর্ষেই রয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি। অন্যদিকে জোরপূর্বক বিবাহ ও বাল্যবিবাহের নিরিখে এগিয়ে রয়েছে আরব ও আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলি। এই ঘটনাকে ‘মানবাধিকারের মৌলিক অপব্যবহার’ হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন আইএলও মহাসচিব গে রাইডার। ‘আধুনিক দাসত্ব’-এর রেশ টানতে প্রতিটি দেশেই বিশেষ আইন এবং জাতীয় নীতি প্রণয়নের আর্জি জানাচ্ছেন তিনি। তবে আদৌ কতটা নিয়ন্ত্রণে আসবে এই পরিস্থিতি, তা নিয়ে সন্দিহান সকলেই…

Powered by Froala Editor