এখনও আতঙ্ক কাটেনি মানুষের। চারিদিকে ধ্বংসের চিহ্ন; মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে পরিবারগুলো। অসহায়, অভুক্ত জীবন তাঁদের। ইয়াস এরকমই একটি পরিস্থিতিতে রেখে গেল আমাদের। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর এই সাঁড়াশি আক্রমণে ছারখার দক্ষিণবঙ্গের একটা বড়ো অংশ। এই অদ্ভুত এক শূন্য পরিস্থিতির মধ্যে বসে আছি আমরা। এমন সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বারবার পড়েছে বাংলা, বেরিয়েও এসেছে। শুধু চিরন্তন কিছু ছাপ রেখে গেছে। ঠিক যেমন হয়েছিল ভোলা’র ক্ষেত্রে।
‘ভোলা’— আপাত নিরীহ নাম। কিন্তু সত্তরের শুরুতে এই নামটিই শেষ করে দিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানকে। আরও একটি সুপার সাইক্লোনের মুখোমুখি হয়েছিল ওপার বাংলা। সেটা ১৯৭০ সাল। দিকে দিকে তখন আগুন জ্বলছে। ভাষার লড়াই, সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই, সর্বোপরি স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেতেই হবে। শুধু রাস্তায় রাস্তায় নয়; সংসদীয় পথেও যাতে জয় আসে, সেটাও দেখছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তারই মধ্যে আকাশ কালো করে এল। এক শক্তিশালী ঝড় ধেয়ে আসছে বাংলার দিকে। নাম ‘ভোলা’।
১৯৭০-এর নভেম্বর মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের(আজকের বাংলাদেশ) উপকূলে আছড়ে পড়ে ভোলা। গতি ছিল ১৮৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা! আর তখন আবহাওয়া বিজ্ঞান এত উন্নতও ছিল না। কাজেই মানুষজনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, আগাম ব্যবস্থা নেওয়া, রসদ বাঁচানো হয়নি সেরকমভাবে। কাজেই ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেল। ভোলার তাণ্ডব থামার পর চারিদিকে যা দেখা গেল, তা বর্ণনাতীত। গাছপালা, গ্রাম, জমি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আর চারিদিকে শুধু মানুষের মৃতদেহ। সরকারি হিসেবে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল সেই সাইক্লোনের আগমনে! মেঘনার তীরবর্তী গ্রামে ৭৭ হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃতের সংখ্যা। যদিও বেসরকারি হিসেব বলে, ক্ষতির পরিমাণ আরও বহুগুণ বেশি ছিল। ট্রপিকাল সাইক্লোনের ইতিহাসে ক্ষতির দিক থেকে সবচেয়ে ভয়ংকর সাইক্লোনের তকমা পায় ‘ভোলা’।
তবে এই সাইক্লোনের সঙ্গে ওপার বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনেরও যোগ রয়েছে মারাত্মক। পাঁচ লাখের ওপর মানুষ মারা গেলেও, পাকিস্তান সরকার ত্রাণ বা মানুষদের রক্ষা করতে প্রায় কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের নজর ছিল ভোলা’র পরিস্থিতির ওপর। কিন্তু দিনের পর দিন মৃতদেহগুলি একইভাবে একই জায়গায় থেকে গেল। আর এসবই আগুনের আঁচটা বাড়িয়ে দিল। আরও ব্যাপকভাবে সংগ্রাম শুরু হল। বিধ্বস্ত, পেটে খিদে, ছত্রাকার অবস্থা— তার মধ্যেও নতুন করে জেগে উঠল স্বাধীনতার মন্ত্র।
ইতিহাস বলে, সাইক্লোন ভোলা ছিল ক্যাটাগরি-৪’র ঘূর্ণিঝড়। সদ্য আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সেই মাত্রায় ভয়াবহ না হলেও, তার প্রভাব ছাপিয়ে গেছে আমফান কিংবা আয়লার মতো বিধ্বংসী ঝড়ের মাত্রাকেও। এখন আধুনিক হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, আধুনিক হয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু ভয়াবহতা একচুলও কমেনি। দক্ষিণবঙ্গকে দুমড়ে চলে গেছে ইয়াস। ঠিক যেমন ভোলা এসেছিল এককালে…
Powered by Froala Editor