৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮। সদ্য স্বাধীন হয়েছে ভারত। বিড়লা হাউজে দুই নাতনিকে নিয়ে বেরিয়েছেন জাতির জনক, বৃদ্ধ মহাত্মা গান্ধী। বিকেলের প্রার্থনা সভায় যাবেন তিনি। সামনের ভিড় থেকে বেরিয়ে এল একজন। গান্ধীজিকে প্রণাম করল সাগ্রহে। তারপরই পকেট থেকে বের করল বন্দুক। পরপর তিনটে গুলি, আর তার আধ ঘণ্টা পর শেষ হল ভারতের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বের জীবন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু - নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হয়েছেন ‘বাপু’।
তারপর থেকেই, ৩০ জানুয়ারি দিনটি ভারতের ইতিহাসের অন্যতম কালো দিন হয়ে রইল। তবে ৩০ জানুয়ারি গান্ধীর ওপর আক্রমণের একমাত্র দিন নয়। এর আগে আরও পাঁচবার তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই ক’বার অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৪ সালের ২৫ জুন। পুনে কর্পোরেশন অডিটোরিয়ামে বক্তৃতা দিতে আসবেন মহাত্মা গান্ধী। স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধীকে নিয়ে একটি গাড়িতে উঠে রওয়ানা দিলেন সেখানে। সেই সঙ্গে, হুবহু তাঁদের গাড়িটির মতোই দেখতে আরেকটি গাড়ি রওনা দিল পুনে কর্পোরেশনের উদ্দেশ্যে। লেবেল ক্রসিংয়ের জন্য গান্ধীজির গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য দেরিতে ঢোকে সেখানে। সেটাই শাপে বর হয় তাঁর। একই রকম দেখতে আগের গাড়িটি বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছিল যথাস্থানে। হঠাৎই ওই গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। কেউ বা কারা সুযোগ বুঝে গাড়িতে বোম রেখে গেছে। সেদিন লেবেল ক্রসিং বাঁচিয়ে দিয়েছিল গান্ধী এবং তাঁর স্ত্রী’কে; কিন্তু দুইজন পুলিশকর্মী এবং সাতজন সধারণ মানুষ গুরুতর আহত হন।
এই ঘটনার ঠিক দশ বছর পর। সাল, ১৯৪৪। আগা খান প্যালেসে গৃহবন্দি ছিলেন গান্ধীজি। এমন সময় তাঁর ম্যালেরিয়ার উপসর্গ দেখা গেল। তাঁকে ছেড়ে দিল ব্রিটিশ সরকার। শরীর সুস্থ করার জন্য, মহারাষ্ট্রের পঞ্চগনিতে এসে উঠলেন। হঠাৎ একদিন সেখানে একটা বাস এসে ভিড়ল। ১৮-২০ জন বাস থেকে নেমে গান্ধীর উদ্দেশ্যে কটূক্তি করতে লাগল। তিনি ওই দলের নেতাকে ডাকলেন কথা বলার জন্য। কিন্তু নেতা কিছুতেই রাজি নয়। বিকেলের প্রার্থনার সময় গান্ধীজিকে দেখতে পেয়ে ছুরি নিয়ে তেড়ে গেল সেই দলের নেতা। সেইদিনই নিহত হতেন, কিন্তু মণিশঙ্কর পুরোহিত এবং ভিল্লারে গুরুজি এই যাত্রা বাঁচান। আর এই ছুরি হাতে দলের নেতাটি কে ছিলেন জানেন? নাথুরাম বিনায়ক গডসে…
মহাত্মা গান্ধীর জীবনে গডসে পর্বের এই শুরু। এরপর আরও দুইবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন সে এবং তার দল। ওই একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সেবাগ্রামে গান্ধী আর মহম্মদ আলি জিন্নাহের সাক্ষাৎ ছিল। গান্ধীজি ছিলেন মুম্বাইতে। সেখান থেকে যাতে কোনোমতে তিনি বেরোতে না পারেন, তার চেষ্টা করে নাথুরাম। এবারেও সে-ই দলের নেতা, আর এবারও তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল একটি ছুরি। ইঙ্গিতটা কী, সেটা পাঠকদের বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না।
এর ঠিক দুইবছর পর, ১৯৪৬ সালের জুনে গান্ধীজি ট্রেনে পুনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। নিরুল এবং কারজাত স্টেশনের মাঝে হঠাৎই ট্রেনটি বেলাইন হয়ে যায়। বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত, কিন্তু ট্রেনের চালকের বুদ্ধিতে গোটা ট্রেনটাই বেঁচে যায়। ঠিক সময় গতি কম করে দিয়েছিলেন। ফলে, ইঞ্জিনের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হয়নি সেভাবে। ঘটনা ঘটার পর গান্ধীজি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কেন এতবার তাঁর জীবনের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও করেছিলেন।
আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির সরলাকে ‘আধ্যাত্মিক স্ত্রী’ হিসেবে চেয়েছিলেন গান্ধীজি, পিছিয়ে আসেন কস্তুরবার চাপে
মৃত্যুর মাত্র দশদিন আগে, ১৯৪৮-এর ২০ জানুয়ারি আরও একবার চেষ্টা করা হয়। এইবারও মূলে ছিলেন নাথুরাম গডসে। বিড়লা হাউজে গান্ধীজির বক্তৃতা ছিল। প্ল্যান ছিল, নাথুরাম ও তাঁর সঙ্গীরা সেখানে বোমা ফেলবে। লোকেরা যখন তাড়াহুড়ো করে পালাবে, তখন গুলি করা হবে গান্ধীকে। সেই মতো মদনলাল বলে একজন ফটোগ্রাফার সেজে ঢুকেও গেল। কিন্তু ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা কোথায়? বারবার দেওয়ালের আড়ালেই বা লোকাচ্ছে কেন ও? সন্দেহ হয় ট্যাক্সিচালকের। এদিকে বোমা ছোঁড়াও হয়, কিন্তু সেটি একদমই শক্তিশালী ছিল না। প্ল্যান ভেস্তে যায়। মদনলাল গ্রেফতার হয়।
এর পরেরবারটি ছিল ৩০ জানুয়ারি। নাথুরাম নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ছুরির বদলে এদিন ছিল বন্দুক। বাকিটা, আমাদের প্রত্যেকের জানা।
তথ্যসূত্র -
১) ‘5 attempts by Godse to kill Mahatma Gandhi before he succeeded’, Real Report
২) ‘Why did India wait till 1950 to become a Republic? Here’s the fascinating answer’, Jovita Aranha, The Better India
আরও পড়ুন
অবহেলায় দুদিন ঝুলে ছিল ডাকবাক্সেই, ব্রিটেনে উদ্ধার মহাত্মা গান্ধীর ব্যবহৃত চশমা
Powered by Froala Editor