বিশ্বের প্রথম ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় ৩৩ জনই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের

প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য নেই। নেই বিশ্বমানের গবেষণার উপযুক্ত পরিকাঠামোও। শুধু আছে শিক্ষক-শিক্ষিকা আর ছাত্রছাত্রীদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা। আর এটুকু সম্বল করেই বারবার বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। সেই যাত্রাপথেই আবারও এক নতুন মাইলস্টোন। সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত বিশ্বের প্রথম ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর নামের তালিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিদের নাম। একজন দুজন নয়, সব মিলিয়ে ৩৩ জন গবেষকের নাম রয়েছে সেই তালিকায়।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই নয়, এটা নিঃসন্দেহে বাংলার জন্যই এক বিরাট খবর। যাদবপুরের পাশাপাশি তালিকায় আছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সহ বাংলার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিরাও। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই ৩০ ছাড়ায়নি। “বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সত্যিই এ এক দারুণ খবর”, মনে করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান চিত্তরঞ্জন সিনহা। তিনি নিজেও আছেন এই তালিকায়।

অবশ্য গণিতের অধ্যাপক বিভাস গিরি (অপারেশন সায়েন্স ফিল্ডে যিনি তালিকায় নাম তুলে নিয়েছেন) বলছেন, “আরও অনেকের নাম থাকবে বলে আশা করেছিলাম।” তালিকায় ভারতীয়ের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। এক হাজারের বেশি ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম আছে সেখানে। অবশ্য তাঁদের বেশিরভাগই নানা রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সঙ্গে যুক্ত। “বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে কোথায়? আজকের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তো গবেষণার উৎসাহ বা মেধা কোনোটাই কম নেই। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো না পেলে তার বিকাশ হবে কী করে?” স্পষ্ট ক্ষোভের সুর চিত্তরঞ্জন সিনহার কথায়।

বিভাস গিরির কথাতেও উঠে আসছে সেই আক্ষেপের কথাই। তাঁর কাজ মূলত বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গণিতের প্রয়োগ নিয়ে। কিন্তু তার জন্য এগিয়ে আসছেন না এদেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি। “পুরো গবেষণার কাজটাই করতে হচ্ছে তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে। কোনো সংস্থাই বাস্তব নথি হাতে তুলে দিচ্ছে না। নিজের গবেষণাকে সত্যি প্রমাণ করার কোনো জায়গাই প্রায় নেই।” বলছেন তিনি। গণিত বিভাগেরই আরেক অধ্যাপক ফারুক রহমান। তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন মহাকাশের বুকে শর্টকাট পথ বা ওয়ার্ম-হোলের উপস্থিতি প্রমাণ করার জন্য। তাঁকেও গবেষণার জন্য যেতে হয়েছে বিদেশে। একই আক্ষেপের সুরে তিনিও বললেন, “বিদেশে দেখি সমস্ত গবেষণার জন্য কীভাবে শিল্পপতিরা এগিয়ে আসছেন। কিন্তু এদেশে সবটাই ছেড়ে দেওয়া হয় সরকারের উপর। আবার সরকারও প্রতিদিন একটু একটু করে বিনিয়োগ কমিয়ে আনছেন।”

আরও পড়ুন
যাদবপুরে শুরু সাঁওতালি বিভাগ, কলকাতায় প্রথম পাঠ্য হল উপজাতি ভাষা

চিত্তরঞ্জন সিনহা অবশ্য গবেষণার জন্য পুরোপুরি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে রাজি নন। তাঁর কথায়, “শিল্পপতিরা বলে দেন, যে জিনিসটা তৈরি হবে সেটা যেন বাজারে কাজে লাগে। এবার ধরুন, ১৮৪৫ সালে একটা কম্পাউন্ড তৈরি করা হয়েছিল। সেই কম্পাউন্ডটার মেডিসিনাল অ্যাক্সেপ্টিবিলিটি দেখা গেল ১৯৬১ সালে। ১৯৭১ সালে অ্যান্টি-ক্যান্সার ড্রাগ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল সিসপ্লাটিন। আজও সেটাই ক্যানসারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ। কিন্তু ১৮৪৫ সালে যদি বলা হত এর কোনো বাজারমূল্য নেই, এটা নিয়ে গবেষণা হবে না; তাহলে আজ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিকটির সন্ধান পাওয়া যেত না।” যদিও কিছুক্ষেত্রে অবশ্যই শিল্পপতিদের এগিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে, সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনিও। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া অরিত্র মজুমদার বলছেন, “এই করোনা পরিস্থিতিতেই বেশ কিছু মডেল তৈরি করেছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং পড়ুয়ারা। তার মধ্যে আছে মাস্ক ডিটেকটিং টেকনোলজিও। কিন্তু সবই কিনে নিয়েছে বিদেশি সংস্থারা। এদেশের সংস্থা কোনো আগ্রহই দেখায়নি। হয়তো স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির তালিকা প্রকাশের পর একটু উৎসাহ দেখা যাবে তাঁদের।”

সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাফল্যে খুশি সকলেই। সারা দেশে ভূতত্ত্ব গবেষণায় নাম উঠেছে একমাত্র শুভ্রাংশু আচার্যের। তিনিও গবেষণা করেছেন যাদবপুরে বসেই। পরিবেশ গবেষণায় আর্সেনিকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে স্বীকৃতি পেলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী। কিন্তু তার আগেই অকালে চলে গিয়েছেন। নিজের গবেষণার স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না তিনি। তবে ৩৩ জন বাঙালি গবেষকের স্বীকৃতি আসলে সারা বাংলার গর্বের বিষয়। সেই খবর যেন বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়, নতুন প্রজন্মের পড়ুয়ারাও যেন আরও বেশি করে এগিয়ে আসে গবেষণার কাজে, তেমনটাই চাইছেন সবাই।

আরও পড়ুন
যাদবপুরে তৈরি মাস্কের পেটেন্ট নিয়ে গেল আমেরিকা, ক্ষুব্ধ উপাচার্য

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More