মাত্র ৮০০-৯০০ স্কোয়ারফুটের ছোট্ট একটি ঘর। সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে রয়েছেন শতাধিক মানুষ। খাবার বলতে সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা প্যাকেটজাত শুকনো খাদ্য। নেই পানীয় জলের বন্দোবস্ত। ভেন্টিলেটর কিংবা জানলাও নেই কোনো। এমনই অস্বাস্থ্যকর, দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে প্রায় তিন সপ্তাহ বন্দি ছিলেন ইউক্রেনীয় নাগরিকরা। সম্প্রতি রুশ সেনাদের এমনই বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড ধরা পড়ল ইউক্রেনে।
উত্তর ইউক্রেনের (Ukraine) চের্নিহিভ শহরের নিকটবর্তী ইয়াহিদনে (Yahidne) গ্রাম। রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের শুরু থেকেই রুশ সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়েছিল ইয়াহিদনে। তবে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয় মার্চের শেষের দিকে। এক প্রকার যেন খানাতল্লাশ শুরু করেছিল রুশ সেনারা। বাড়িতে ঢুকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বন্দি করা হয়েছিল সাধারণ নাগরিকদের। কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল একটি স্থানীয় স্কুলের বেসমেন্টে। বৃদ্ধ এবং শিশু মিলিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক মানুষকে বন্দি করে রুশ সেনাবাহিনী। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর এই আগ্রাসনের কারণ কী?
মার্চের শেষ দিক থেকেই রুশ অধিকৃত উত্তর ইউক্রেনের অঞ্চলগুলি মুক্ত করার জন্য অভিযানে নামে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। ততদিনে মূল যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে রাজধানী কিভ-সংলগ্ন এলাকা। ফলে ইয়াহিদনে, চের্নিহিভ-সহ উত্তর ইউক্রেনের অধিকাংশ অঞ্চল থেকেই বেশিরভাগ সেনা ও সামরিক অস্ত্র কিভের দিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ইউক্রেনীয় সেনাদের ঠেকাতে তাই সাধারণ নাগরিকদেরই মানবপ্রাচীর হিসাবে ব্যবহার করে রুশ বাহিনী।
স্কুলের ‘পাতালঘর’-এ ২২ দিনের বন্দিদশা একপ্রকার বিভীষিকার মতোই। সূর্যের আলো প্রবেশ করা তো দূরের কথা, প্রতিনিয়তই এই ‘ঘুমঘর’ কেঁপে উঠত মর্টারের বিস্ফোরণে। সেইসঙ্গে গোলাগুলির শব্দ। যেন মৃত্যু হাতছানি দিত প্রতি মুহূর্তে। খাবার ও পানীয় জলের সংকটও ক্রমশ বেড়েছে দিনে দিনে। দিনে একবার হয়তো প্যাকেট খাদ্য দিয়ে যেত অস্ত্রসজ্জিত রুশ সেনারা।
তবু এসবের মধ্যেই অন্য এক পৃথিবী খুঁজে নিয়েছিলেন বন্দি ইউক্রেনীয়রা। বেসমেন্টের দেওয়ালই হয়ে উঠেছিল ছোট্ট ছোট্ট শিশু-কিশোরদের ক্যানভাস। আজও সেখানে ফুটে রয়েছে আতঙ্কের চিত্ররূপ। দেওয়ালেই কেউ আবার খোদাই করে হিসেব রেখেছিলেন ক্যালেন্ডারের। ২২ দিন পর মুক্তির স্বাদ মিলেছিল হঠাৎ করেই। দরজা খুলে এক গ্রামবাসীকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন বন্দিরা। শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয়েছিল রুশ সেনারা। তবে বন্দিদের মুক্ত করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি তাঁরা। এমনকি বন্দিদের অবস্থান সম্পর্কে জানতেন না ইউক্রেনের সেনারাও। নিকটবর্তী শহরে পালিয়ে যাওয়া কিছু গ্রামবাসীই পরবর্তীতে উদ্ধার করেন তাঁদের।
সম্প্রতি, সিএনএন, বিবিসি-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সৌজনে প্রকাশ্যে এসেছে এই বীভৎসতার ছবি। প্রকাশ্যে এসেছে গুমঘরের দিনলিপি। যদিও এই বিভীষিকা থেকে বেঁচে ফিরতে পারেননি সকলে। দমবন্ধ আবহাওয়ায় শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছিল ৮ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার। উত্তর ইউক্রেনের এই ভয়াবহ ঘটনা যেন ফিরিয়ে দিচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের স্মৃতি…
Powered by Froala Editor