লকডাউনের মধ্যেই দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাস্তায় হেঁটে বাড়িতে ফেরার ছবি কেউই ভুলে যাইনি আমরা এখনও। অমানুষিক পরিশ্রম, খিদে অথবা ক্লান্তিতে কাতর অবস্থায় ঘরে ফেরা হয়নি তাঁদের অনেকেরই। রাস্তাতেই বহু শ্রমিক ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। অথচ গত সপ্তাহেই লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধান শাসক দল জানিয়েছিল লকডাউনের সময় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে কত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, তার কোনও সঠিক তথ্য নেই সরকারের কাছে।
দীর্ঘদিন ধরেই পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে সরব হয়েছিল বিরোধীরা। অথচ শাসকদল দেখিয়ে দিয়েছিল কী সহজে ঝেড়ে ফেলা যায় সমস্ত দায়। যেহেতু কোনও তথ্যই নেই, সেহেতু মৃত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও কোনো প্রশ্নই ওঠে না— এমনই জানানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় শ্রমদপ্তরের তরফে। সমস্ত ঘটনাটিকেই রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি এর দায় চাপানো হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়ানো মিডিয়ার দিকে। বলা হয়েছিল, মিডিয়ার ছড়ানো ভুল খবরের জেরেই বিভ্রান্ত হয়ে দলে দলে বাড়ি ফিরতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছিলেন খোদ পরিযায়ী শ্রমিকরাই!
স্বাভাবিকভাবেই তার পর থেকেই তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছিল সারা দেশে। কীভাবে এত দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করতে পারে কেন্দ্রের শ্রমদপ্তরের প্রতিনিধিরা, তা নিয়ে চোখ কপালে তুলেছিলেন অনেকেই। পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ কুমার গাংওয়ার। মূলত দেশজুড়ে শুরু হওয়া সমালোচনার চাপে পড়েই তারপর কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসে শ্রম মন্ত্রক। অবশেষে শ্রমদপ্তরের তরফে জানানো হয়, করোনা মহামারী ঠেকাতে দেশজুড়ে যে লকডাউন ডাকা হয়েছিল, সেই সময় শুধুমাত্র মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যেই পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন এক কোটিরও বেশি শ্রমিক।
কেন এই তথ্য প্রকাশ করতে দেরি হল? কেন্দ্র যথারীতি দায় চাপিয়েছে রাজ্য সরকারগুলোর উপর। কেন্দ্রের তরফে রাজ্যসভায় জানানো হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি থেকে এই বিষয়ে সঠিক সময়ে তথ্য না পাওয়ার জন্যই দেরি হয়েছে সঠিক রিপোর্ট পেশ করতে। তারপরেও অবশ্য কেন্দ্র অবশেষে যে তথ্য জানিয়েছে, তা শিউরে ওঠার মতো। বলা হয়েছে যে মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় ৮০ হাজারেরও বেশি পথ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। এইসময় পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের। রেললাইনের উপরেই ঘুমিয়ে পড়া শ্রমিকদের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ছবি এখনও তো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় অনেককেই। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে জানানো হয়েছে, এর মধ্যে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে আলাদা কোনো তথ্য কেন্দ্রের কাছে নেই।
গত সপ্তাহেই সংসদ উত্তাল হয়েছিল রেলমন্ত্রীর পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু বিষয়ে নীরবতা নিয়ে। অবশেষে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়েছেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে মৃত্যু হয়েছে ৯৭ জন পরিযায়ী শ্রমিকের। যদিও রেল মন্ত্রকের তরফে এটাও জানানো হয়েছে যে, তাদের কারোর পরিবারকেই কোনওরকম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি এখনও।
এইসবের মধ্যেই লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়ে অসীম দুর্দশার মধ্যে দিন গুজরান করছেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। এমনকি পরিযায়ী শ্রমিকদের এই পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জকেও। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা হল, সঠিক তথ্য জানার অধিকার তো দেশের সমস্ত নাগরিকেরই রয়েছে। গণতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠানটিতেই দাঁড়িয়ে সেখানে সরকারি যদি বলে যে, তাদের কাছে দেশের অজস্র অসহায় মানুষের মৃত্যুর কোনও তথ্য নেই, তাহলে অবাক হতে হয় বৈকি!
আরও পড়ুন
দুর্গাপুজোর দিনেই ইউজিসির প্রবেশিকা পরীক্ষা, বাংলার পড়ুয়া ও সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা কেন্দ্রের?
যদিও এর মধ্যেই কেন্দ্র কত উদার এবং দয়ালু সে বিষয়ে ফিরিস্তি দিতে ভোলেননি কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী। কেন্দ্রের তরফে বলা হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাবার, থাকার জায়গা, চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং কাউন্সিলিং করানোর জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সাহায্যে যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি কেন্দ্রের উদ্যোগেই শ্রমিকদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছিল। যদিও পরিযায়ী শ্রমিকদের যে ছবি দিনের-পর-দিন ভেসে উঠেছে চোখের সামনে, তাকে যদি ‘সুবিধা’ বলা হয় তাহলে সেটাকে পরিহাসের মতোই শুনতে লাগে। এতকিছুর পরে তাই অবশেষে নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া অসহায় মানুষগুলোর মৃত্যুও যেভাবে পরিহাসের বিষয় হয়ে উঠছে, সেটাই দুর্ভাগ্যের।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আর্জি কেন্দ্রের, অপপ্রচার আটকানোর আড়ালে কি বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?