ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় পর্বত। আর সেই পর্বত পেরোলেই আছে এক আশ্চর্য দেশ। চিন। না, বিরাট হিমালয় কোনোদিনই এই দুই দেশের যোগাযোগের মধ্যে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। বহু প্রাচীন কাল থেকেই দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান চলেছে অসংখ্য পার্বত্য উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। ভারত থেকে যেমন বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছে গিয়েছে চিনে, আবার চিন থেকে এসেছে তন্ত্রসাধনা। তবে সেসব বহু প্রাচীন কালের কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়েও এই ইতিহাসে ছেদ পড়েনি কোথাও। এমনকি ভারতের শ্রেষ্ঠ অসামরিক পুরস্কার পদ্ম পুরস্কারের তালিকাতেও আমরা দেখেছি চিনের নাগরিকদের নাম।
গতবছর ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তরফ থেকে জানানো হয়েছে এখনও পর্যন্ত মোট ২৭২ জন বিদেশি এবং প্রবাসী ভারতীয় পদ্ম পুরস্কার পেয়েছেন। আর সেই তালিকাতে আছে চিনের নাগরিকদের নামও। ২০০৮ সালে প্রথম পদ্মভূষণ পুরস্কার পান চিনের শিক্ষাবিদ জি শায়ানলিন। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে দশ দিনের চিন সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শায়ানলিনের পদ্ম পুরস্কার পাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। আর এই সংবাদ দুই দেশের মধ্যেই এক চরম উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল।
খাঁকি জামা আর কাপরের তৈরি জুতো, কাঁধে চামড়ার ব্যাগ। জি শায়ানলিনকে দেখে শিক্ষাবিদ বলে মনে করা কঠিন। মনে হয় যেন চিনের অতি দরিদ্র এক কৃষক। অথচ নিজের প্রতিভার গুণে তিনি তিনি সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। ইতিহাসকে দেখার এক আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি খুলে দেয় তাঁর গবেষণা। আর সেই গবেষণার একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে সংস্কৃত ও পালি ভাষা এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এমনকি চিনের মানুষকে সেই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে তোলার জন্য তিনি রামায়ণ সহ বেশ কিছু সংস্কৃত কাব্য অনুবাদ করেন ম্যান্ডালিন ভাষায়।
২০০৬ সালে নিরুপমা রাওয়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারের সূত্রে শায়ানলিনের কাজের সঙ্গে পরিচিত হন ভারতের মানুষ। আর তার পরেই কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৮ সালে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। আর সেইসঙ্গে ভারত ও চিনের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের রাস্তাও প্রসারিত হয়। গতবছর শায়ানলিনের আত্মজীবনীর হিন্দি এবং ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয় দিল্লি থেকে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুই অনুবাদের উদ্বোধনের সাক্ষী থেকেছিলেন অসংখ্য ভারতীয়।
আরও পড়ুন
৫৮ বছর আগেও চিন-ভারত যুদ্ধে ভারতের ট্রাম্প কার্ড তিব্বতী সেনারা, পরিকল্পনায় এক বাঙালি
শায়ানলিনের মতোই আরেক চৈনিক ভারততাত্ত্বিক হুয়াং বাওসেং। তিনি অবশ্য ইতিহাসের থেকে সাহিত্য এবং সংস্কৃতির উপরেই বেশি জোর দিয়েছেন। আর এই সংস্কৃতির শুলুকসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই দাঁড়ান মহাভারতের সামনে। ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মহাভারতের আদিপর্বের ম্যান্ডালিন অনুবাদ। অনুবাদক হুয়াং বাওসেং। ২০০৩ সালের মধ্যে সমগ্র মহাভারতের অনুবাদ করেন তিনি। এছাড়াও ভাগবদগীতা, ললিতবিস্তার সূত্র এবং বজ্রছেদিকাসূত্রের অনুবাদও করেছেন তিনি। আর প্রতিটি অনুবাদই চিনে বিশেষভাবে সমাদৃত। ২০১৫ সালে তাঁকেও সম্মান জানিয়েছিল ভারত সরকার। সেবারের পদ্মশ্রী পুরস্কারের তালিকায় ছিল আরও এক চৈনিক নাগরিকের নাম।
দ্বিতীয় এনডিএ সরকারের প্রথম পদ্ম পুরস্কারের তালিকায় নাম ছিল হুয়াং বাওসেং-এর। আর দ্বিতীয় তালিকায় আবারও এক চৈনিক নাগরিকের নাম দেখা যায়। যদিও তিনি জন্মসূত্রে চৈনিক হলেও সারা পৃথিবীকেই নিজের দেশ বানিয়ে নিয়েছেন। সমস্ত পৃথিবী ঘুরে প্রচার করেন যোগের মাহাত্ম্য। তাঁর নাম হুই লান জাং। তবে ওয়াই-লানা নামে সমাধিক পরিচিত। ‘ওয়াই লানা ইয়োগা’ নামে এক পৃথক ঘরানারও জন্ম দিয়েছেন তিনি। আর সেই ঘরনায় চিনের চিরাচরিত ইয়োগার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন ভারতীয় যোগশাস্ত্রও। বর্তমান সরকার যোগের প্রচারে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর সেই সূত্রেই ২০১৬ সালে ওয়াই লানাকে সম্মানিত করেন পদ্মশ্রী পুরস্কারে।
আরও পড়ুন
চিনের মাটিতে তৈরি হচ্ছে ভারতীয় চিকিৎসকের ব্রোঞ্জ মূর্তি - দ্বন্দ্বের মধ্যে মৈত্রীর বার্তা?
এরপর আর মাত্র ৪ বছর পেরিয়েছে। অথচ তার মধ্যেই পুরো ছবিটা কেমন আমূল বদলে গেল। সৌজন্যে ভারত-চিন যুদ্ধ পরিস্থিতি। চিন-ভারত সংঘর্ষের প্রভাব পড়েছে প্রতিটা মানুষের মানসিকতায়। চিনের সমস্ত মানুষকেই ভারতীয়রা যেন শত্রু ভাবতে শুরু করেছেন। অথচ যুদ্ধ তো হয় রাজায় রাজায়। মানুষের মধ্যে কিন্তু সহযোগিতার হাত খোলা থাকাই উচিত। সীমান্তের যুদ্ধও তো একদিন মিটে যাবে। আবারও রাজনৈতিক মৈত্রী গড়ে উঠবে দুই দেশের মধ্যে। আবারও প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে আমন্ত্রিত হবেন চিনের রাষ্ট্রনায়করা। কিন্তু মানুষে মানুষের বিদ্বেষের মানসিকতা এত তাড়াতাড়ি মুছে যাবে কি?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
‘অপরাধ’ চিনে জন্মগ্রহণ করা, ’৬২-র যুদ্ধে গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি ৩০০০ চিনা-ভারতীয়