বিক্রির পথে ২৬টি রাষ্ট্রীয় সংস্থা; পরিষেবা ‘ভালো’ রাখতে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের?

গত ২৭শে জুলাই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানিয়েছিলেন ২৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পাওয়া গেলেও কোন কোন সংস্থা তা স্পষ্ট করা হয়নি তখন। যদিও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে, তার বেশি সংস্থাকেও বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে পারে সরকার। আদতে ঘটল সেটাই। ২৩টি নয়, বরং মোট ২৬টি সরকারি সংস্থা থেকে নিজের অংশ বিক্রি করে দিতে চলেছে মোদি সরকার। অর্থমন্ত্রকে তথ্য জানার অধিকার আইনে প্রশ্ন করার পরেই সামনে এসেছে এই সত্য।

সম্প্রতি প্রকাশিত আর্থিক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, বিগত চার দশকের মধ্যে রেকর্ড হারে পতন হয়েছে জিডিপির। জি২০ দেশগুলির মধ্যে সবথেকে খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে ভারত। যদিও জিডিপির রিপোর্ট যাই বলুক না কেন, দেশ এখনও আর্থিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে স্বীকার করা হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে। কিন্তু আর্থিক মন্দার কথা স্বীকার না করা হলেও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কথা বারবার শোনা গিয়েছে কেন্দ্রের মুখে। প্রশ্ন উঠেছে, এই ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত কি তাহলে ঝিমোনো অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার জন্যই নেওয়া হল?

যে সকল সংস্থাগুলিকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে এয়ার ইন্ডিয়া, সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, সিমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড, সালেম স্টিল প্লান্ট, দুর্গাপুর স্টিল প্লান্ট, ভারত পেট্রোলিয়াম, হিন্দুস্থান নিউজপ্রিন্ট লিমিটেড, ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন ইত্যাদি। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের স্বপ্ন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডও আছে কেন্দ্রের এই বেসরকারিকরণের তালিকায়।

করোনা মহামারীর পর থেকেই কেন্দ্র বরাবর এই পরিস্থিতিকে দায়ী করে এসেছে দেশের আর্থিক অবনতির জন্য। তবে দেশের অর্থনীতির কোমর যে আগে থেকেই ভাঙতে শুরু করেছিল, সেই বিষয়ে বারবার অবগত করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। তাই এখন এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, আদতে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেসরকারিকরণ করতে কোভিড পরিস্থিতি সরকারের আখেরে সুবিধাই করে দিল কিনা?

আরও পড়ুন
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর বেসরকারিকরণ; অর্থনীতি কি দিশাহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশই?

বস্তুত দ্বিতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেই আর্থিক উদারীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে খারাপ হয়ে চলেছিল কোষাগারের অবস্থা। তাই বেহাল কোষাগার সামলাতে অর্থের যোগান জারি রাখতেই একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রির এই প্রক্রিয়া, কেন্দ্রের তরফেই তা স্বীকার করা হয়েছে। এমনকি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বেসরকারিকরণের কাজ কেন্দ্র সম্পূর্ণও করে ফেলতে চায় বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। অর্থাৎ সরকার যে কতটা একরোখা এই বিষয়ে তার একটা নির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে এই ঘটনায়।

যদিও সরকার দাবি করেছে এয়ার ইন্ডিয়া নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ রয়েছে, তবু বাস্তবে কিন্তু সেই ঘটনার সত্যতা বোঝা যায়নি। বরং ক্রমাগত লোকসানে চলা এই সংস্থা বিক্রি করতে গিয়ে রীতিমতো নাকাল হয়েছে সরকার। তাই এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কেন এভাবে দিনের পর দিন ঋণের ভারে নুইয়ে গেল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি? কেন আগে থেকেই দেশের স্বার্থে সংস্থাগুলিকে বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নিতে দেখা গেল না সরকারকে?

আরও পড়ুন
বন্ধ করা হবে রেলপথের ৬০০০ স্টপেজ, বেসরকারি মনোভাবেরই লক্ষণ?

চলতি বছরে বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৩.৩ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। কিন্তু মন্দার কারণে এবং দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের ফলেও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে সেই লক্ষ্যমাত্রা কতটা পূরন হবে, তা নিয়ে সন্দেহ ঘনিয়েছে জোর। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একমাত্র উপায় যদি হয় দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া, তাহলে সত্যি সত্যি স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে গর্ব করার কোনও জায়গা রয়ে যায় কি?

কেন রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থাগুলিকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্র? নাকি কেন্দ্র এই সংস্থাগুলির দায় আদৌ আর বহন করতে রাজি নয়? সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম সংস্থা বিএসএনএলের ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাপোড়েন সামনে এসেছে বারবার। নাকচ হয়ে গেছে বিএসএনএলের পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, টেলিকমের এই পরিকাঠামো কিন্তু দেশের জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের অর্থ থেকেই তৈরি।

আরও পড়ুন
বেসরকারি হাতে যাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও? মিলছে তেমনই ইঙ্গিত

এছাড়াও দেখা গিয়েছে ব্যাংক শিল্পকে চাঙ্গা করতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বিক্রির সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে যে, ব্যাঙ্কিং সেক্টরে সংস্কার সাধনের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। কেবল মাত্র চারটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাংক আগামী দিনে হাতে রেখে বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে স্বেচ্ছা অবসর  অথবা বিশেষ অবসর প্রকল্প। তাই এই সংস্কারের সিদ্ধান্ত আদৌ কতটা উন্নয়নমূলক, তা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ কিন্তু থেকেই যায়।

এখানেই শেষ নয়। বেসরকারিকরণের হাত পড়েছে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও। দেশের সব ক্ষেত্রে গালভরা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র কথা বললেও, আদতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির উদ্যোগ তেমন দেখা যায়নি। বরং সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থাকে মুনাফা লোটার জন্য। ইতিমধ্যেই যুদ্ধবিমান তৈরির সংস্থা হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড বা হ্যাল-এর ১৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করতে কেন্দ্রের কোনও আপত্তি নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে সরকার। 

আরও পড়ুন
রেলের বেসরকারিকরণ হোক বা না-হোক, হকারদের ভাগ্য বদলাবে কি?

যদিও কেন্দ্র যে ক্রমাগত এই পথেই হাঁটতে চলেছে সেই ব্যাপারে একটা আভাস কিন্তু পাওয়া গিয়েছিল আগেই। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, শিল্প বা বাণিজ্যে কেন্দ্র সরকার আর থাকতে রাজি নয়। একধাপ এগিয়ে জানিয়েছিলেন, কোনও শিল্প চালানো সরকারের দায়িত্বই নয়। যদিও সরকারের তরফ থেকে লোকসানে চলা সংস্থাগুলিকে দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ঘটনাটি সম্পূর্ণ উল্টো। সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে পরিষ্কার যে, এদের মধ্যে আটটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছাড়া বাকি সব সংস্থাই লাভজনক। তাহলে কেন এই বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত? শিল্প দপ্তর আঙ্গুল তুলেছে নীতি আয়োগের দিকে। ব্যাপারটা এরকম যে, বর্তমান জমানায় শিল্প দপ্তর নয়, বরং নীতি আয়োগই যেন চৈত্র সেলের বাজার খুলে বসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে নিয়ে। শুনতে হয়তো আশ্চর্য লাগতে পারে, কিংবা নাও লাগতে পারে, যে এই নীতি আয়োগের মাথায় কিন্তু বসে আছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীই।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More