আজ যেখানে বউবাজার স্ট্রিট, একসময় সেই রাস্তাকে সাহেবরা ডাকতেন ফ্ল্যাগ স্ট্রিট নামে। ফ্ল্যাগ স্ট্রিট কেন? কারণ রাস্তার দুধারে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যেত নানা দেশের পতাকা। ব্যবসার সূত্রে প্রত্যেকেই এসেছে কলকাতায়। আর তাই খরিদ্দারের কাছে নিজের এবং দোকানের পণ্যসামগ্রীর পরিচয় বোঝাতে নিজের দেশের পতাকা ঝুলিয়ে রাখতেন। হয়তো কোনো জার্মান সেপাই জার্মানির ফ্ল্যাগ দেখে ঢুকে পড়ল, বা ডেনিস সেপাই ঢুকে পড়ল ডেনমার্কের ফ্ল্যাগ দেখে। আবার এখানে ক্রিস-ক্রস ব্যবস্থাও চলত। বিশেষ করে ডেনমার্কের জিনিস প্রত্যেকেরই খুব প্রিয় ছিল।
এখন ভাবছেন নিশ্চই, পণ্যসামগ্রীটি আসলে কী? সে কলকাতার জীবনে এক নতুন আমদানি। একধরনের পানীয়, যা গলা দিয়ে নামা মাত্র নেশা ধরিয়ে দেয়। হ্যাঁ, মদ। যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন কলকাতার অভিজাত বাঙালিরাও এই পানীয়টিকে আপন করে নিয়েছে। কিন্তু ট্যাভার্ন বা পাঞ্চ-হাউসে গিয়ে নেশা করা তাঁদের মর্যাদার পরিপন্থী। এগুলো তৈরি হয়েছিল বিদেশিদের জন্য, বিদেশিদের দ্বারা, বিদেশিদের। না, একটু ভুল হল। সবগুলো পাঞ্চ-হাউস বিদেশিদের নয়। বাঙালিরাও সমানভাবে নেমে পড়েছিলেন পানীয়ের ব্যবসায়। একেবারে প্রথম দিকে গোবিন্দ শুঁড়ির পাঞ্চ-হাউসের কথা জানা যায়। এরপর আরেকটি পাঞ্চ-হাউসের কথা বলতেই হয়। এটি তৈরি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ দত্ত নামে এক বাঙালি ব্যবসায়ী। যদিও ঘরটির অবস্থা খুব একটা শ্রীযুক্ত ছিল না। কাঠের আসবাবপত্রও ছিল না কিছুই। এমনকি দু-একটা ভাঙা চেয়ার-টেবিলও না। কিন্তু যে মধুর টানে সেখানে সাহেবরা এসে ভিড় জমাতেন, তার জুড়ি এই চত্বরে আর কোথাও ছিল না। একমাত্র এখানেই পাওয়া যেত দিশি পচাই মদ।
তবে এই ব্যবসায় একটা সমস্যায় মাঝেমাঝেই পড়তে হত শ্রীকৃষ্ণ মহাশয়কে। সেটা ভাষার সমস্যা। এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে খরিদ্দার বিক্রেতার ভাষা বোঝে না, আবার বিক্রেতাও খরিদ্দারের ভাষা বোঝে না। আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য বেছে নেওয়া হত আদিম সাংকেতিক ভাষা। তবে এভাবে খুচরো বিক্রিবাটা চললেও কোনো খরিদ্দাররা কোনো বিষয় নিয়ে অভিযোগ জানাতে গেলে সমস্যায় পড়তেন। তখন হাত-পা নেড়ে এক বিশ্রী অবস্থা তৈরি হত।
তবে ট্যাভার্ন বা পাঞ্চ-হাউসের সঙ্গে আজকের বাঙালি সেভাবে আর পরিচিত নয়। আজকাল মদ খাওয়ার জন্য আছে বার বা ইন। পাঞ্চ-হাউস এবং ট্যাভার্ন এদেরই উনিশ শতকের বিলিতি সংস্করণ। এমনিতেই তখন কলকাতার সাহেব পাড়ায় ঘুরে বেড়ালে মনে হত যেন আরেকটা লন্ডন। সেই অনুভূতিকেই আরও বাড়িয়ে তুলত পাঞ্চ-হাউস, ট্যাভার্ন এবং কফি হাউস। পাঞ্চ-হাউস মানে সেখানে শুধুই পানীয় পাওয়া যাবে। তবে ট্যাভার্ন এবং কফি-হাউসের মূল ভূমিকা ছিল বিশ্রামাগার হিসাবে। এখানে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কফি বা সুরাপানের সঙ্গে ছিল সংবাদপত্র পাঠের সুযোগও। ১৭৮০ সালের এক কলকাতা পর্যটকের বর্ণনা অনুযায়ী একটি কফি-হাউসে ক্যালকাটা অ্যাডভার্টারাইজার, ক্যালকাটা ক্রনিক্যাল প্রভৃতি পত্রিকা পাওয়া যেত।
মূলত আঠেরো শতকের শেষ দিকে থেকে লালবাজার, ডালহৌসি, বেন্টিংক স্ট্রিট এবং বউবাজার অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল পাঞ্চ-হাউসগুলি। নানা দেশের খরিদ্দারদের পছন্দ অনুযায়ী পুরনো আরকের সঙ্গে পরিবেশন করা হত নানা ধরনের ফ্লেভার, গন্ধ। আর এইসব মিশিয়ে একটি মধুময় পরিবেশ চারিদিকে ম-ম করত। সেই মধুর টানে যে শুধু 'লোফার' সাহেবরাই আসতেন তা নয়। হিকি সাহেবের মতো অভিজাত উকিলের সারাদিনের ঠিকানাও ছিল এখানেই।
তবে শ্রীকৃষ্ণ দত্ত মহাশয় কিন্তু কফি-হাউস বা ট্যাভার্নের ব্যবসার দিকে ঝুঁকলেন না। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, নেশা জিনিসটার একটা দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা আছে। আর বিলিতি পানীয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যে বাংলার পচাই মদ পিছিয়ে থাকবে না, তাই আন্দাজ করেছিলেন। আর তাই তাঁর পানশালায় ভালোভাবে বসার বন্দোবস্ত না থাকলেও দেশ বিদেশের নানা খরিদ্দারের ভিড় উপচে পড়ত। ঠিক যেন দেশীয় শিল্পের এক আন্তর্জাতিক বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এই কলকাতার বুকেই। আজ আর সেসবের খবর কতজনই বা রাখে?
আরও পড়ুন
গাঁজা টানার ক্ষমতা অনুযায়ী দেওয়া হত নাম, পুরনো কলকাতার গঞ্জিকা সেবনের ইতিহাস এমনই
তথ্যসূত্রঃ পাঞ্চ হাউসের সামনে খাটিয়া পেতে ঘুমোত সাহেবরা, অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
টাউন কলিকাতার কড়চা, বিনয় ঘোষ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
এক বাসে সরাসরি কলকাতা থেকে লন্ডন, ৫০ বছর আগে পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট ছিল এটিই