করোনার দুর্যোগে থেমে গেছে সমস্ত সমাজ। সামাজিক দূরত্ব মেনে বাড়িতেই চলছে অফিসের কাজ। লকডাউন শিথিল হবার পর মানুষজন বেরোতে আরম্ভ করলেও রাস্তাঘাটের অবস্থা যে খুব একটা ভালো, তা বলা যাবে না। এমন অবস্থায় অনেকেই অপেক্ষা করে আছেন একটি খবরের জন্য। কবে চালু হবে লোকাল ট্রেন? কবে চালু হবে মেট্রো? কলকাতার অন্যতম ভরসার মুখ যে যানটি, সেটির বন্ধ দরজা হতাশ করেছে অনেককে। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই, কিছু করার নেই। রোগ থেকে বাঁচতে হলে একটু তো সামলে চলতে হবে!
অবশ্য কলকাতা মেট্রো কর্তৃপক্ষের তরফে সুসংবাদটি ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। করোনা অতিমারীতে দীর্ঘদিন স্তব্ধ থাকার পর চালু হচ্ছে মেট্রো। যেহেতু করোনা ভাইরাস বিদায় নেয়নি এখনও, কাজেই নতুন কিছু নিয়ম অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সব শেষে মেট্রো যে চলছে, এটাই শহরবাসীর মনে স্বস্তি এনেছে। হ্যাঁ, এমনই ভরসার জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে যানটি। শত খারাপ অভিজ্ঞতা পেরিয়েও মেট্রো কলকাতার অন্যতম শিরদাঁড়া…
কলকাতা মেট্রোর জন্য সেপ্টেম্বর মাসটি এমনিতেই বেশ উল্লেখযোগ্য। কারণ জানতে গেলে একটু পেছনে যেতে হবে। কুইজের প্রশ্নের মতো যদি জিজ্ঞেস করা হয় ভারতের প্রথম মেট্রো কোথায় কবে শুরু হয়েছিল, উত্তর আসতে বোধহয় খুব একটা দেরি হবে না। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে এই কলকাতাই সাক্ষী থেকেছিল সেই ইতিহাসের। কিন্তু সেখানেই থেমে যায় না গল্পটা। তার আগে এবং পরে আরও বহু ঘটনা এই সালটিকে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে। কলকাতার মাটির নিচ দিয়ে ছুটবে বিশেষ ট্রেন, এমন পরিকল্পনা আরও আগের। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্ন ছিল এই মেট্রো। কিন্তু তখন সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ পায়নি। কিন্তু মরে যায়নি সেসব…
সত্তরের দশকে এসে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে, দেশে মেট্রো তৈরির প্রকল্প নেওয়া হবে। আর তার শুরুটা করা হবে কলকাতায়। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। সমীক্ষা চালিয়ে কলকাতায় মেট্রোর তিনটে রুট ঠিক করা হয়। তার মধ্যে থেকে দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো পরিষেবাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর শুরু হয় কাজ। শহর জুড়ে শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ি। তৈরি হতে শুরু করল একটা স্বপ্ন।
আরও পড়ুন
নবাবি ঐতিহ্য এখন অতীত, কলকাতার বুকে মৃত্যুর দিন গুনছে ‘মুর্শিদাবাদ হাউজ’
এখানেই শুরু হবে আমাদের কাহিনি। উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতাকে জোড়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। মাটির নিচ থেকে টানেল তৈরির কাজ তো এগোতে লাগল। কিন্তু প্রথমদিন দমদম থেকে যাত্রা শুরু করে একবারেই মেট্রো টালিগঞ্জ পৌঁছে গেল— এমনটা হয়নি। গোটা প্রোজেক্টটাকে ছোটো ছোটো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। তারপর সেগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে তৈরি হয় উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক। দীর্ঘ দশটি বছর কাজ চলার পর ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর যাত্রা শুরু করল কলকাতা মেট্রো। কিন্তু সেই যাত্রাটি ছিল এসপ্ল্যানেড থেকে ভবানীপুর (নেতাজি ভবন) পর্যন্ত; সব মিলিয়ে মোট পাঁচটি স্টেশন। বলা যেতে পারে এরাই শহরের প্রথম পর্যায়ের মেট্রো স্টেশন।
একটু একটু করে যত সময় এগিয়েছে, মেট্রো নিজের ডানা খুলেছে। এসপ্ল্যানেড-ভবানীপুরের পর বেলগাছিয়া আর শ্যামবাজারকে জোড়া হল। ছোট্ট এই লাইনটি ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসে আরেকটু বেড়ে দমদম অবধি গেল। ওই বছরেই পরপর শ্যামবাজার, শোভাবাজার, গিরিশপার্ক। শোভাবাজার স্টেশন খোঁড়াখুঁড়ির সময় আবার মাটির তলা থেকে পাওয়া গেল ঘটি, বাটি, থালা; যা এখনও স্টেশনের ভেতর সংরক্ষণ করে রাখা আছে। এর পাশাপাশি এসপ্ল্যানেড-চাঁদনি চক-সেন্ট্রাল জুড়ে দিয়েছে মেট্রো। দক্ষিণেও টালিগঞ্জ অবধি লাইন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। একদিক থেকে প্রায় পুরোই হয়ে গেছে মেট্রো। কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক যেন দেখা যাচ্ছে! উত্তর আর দক্ষিণ তো যুক্ত হয়নি। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় বসে গেল আরও একটি স্টেশন— মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশন।
আরও পড়ুন
ক্রিকেট, হকি, ফুটবল – কলকাতার খেপ খেলার দুনিয়ায় একমেবাদ্বিতীয়ম রিচার্ড হুপার
১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটিতেই পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো পরিষেবা। দমদম আর টালিগঞ্জের দূরত্বটা এক ধাক্কায় কমিয়ে দিল অনেকটা। তারপর সময় এগিয়েছে সময়ের মতো। আরও নতুন স্টেশন যুক্ত হয়েছে, নাম বদলেছে। মেট্রো ইতিমধ্যে গঙ্গাও পেরিয়ে পৌঁছে গেছে হাওড়ায়। সেই পথটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই কদিন। করোনার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন মেনে আবারও পথ চলল মেট্রো। আর সেটাও ঘটল পয়মন্ত সেপ্টেম্বরেই…
Powered by Froala Editor