কলকাতার কোনো 'জন্মদিন' নেই, প্রতিষ্ঠাতা নন জোব চার্নকও!

তিন শতকের শহর, তিন শতকের ধাঁধা
সুতানুটির পাড়ে নেমে এলেন সাহেবজাদা

কলকাতা শহরের তিনশো বছর পূর্তি উপলক্ষে এই গানটি লিখেছিলেন কবীর সুমন। সে-সময় কলকাতায় উদযাপন তুঙ্গে। মহানগরীর ৩০০ বছর বলে কথা! এর মধ্যে কত ঘটনা, কত বদল। তবু গুরুত্ব হারায়নি তিলোত্তমা। বয়স বাড়লেও যৌবন ধরে রেখেছে সে। আজও তো, নির্জন দুপুরে কিংবা ব্যস্ত সন্ধেয় তার বয়স কি একটুও ছায়া ফেলে?

কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক – এই কথাটির সঙ্গেই আম বাঙালি পরিচিত। অনেকে এও জানেন, ২৪ আগস্ট ১৬৯০ সালে চার্নক কলকাতায় পদার্পণ করেন, সেই হিসেবে ২৪ আগস্টই হল কলকাতার জন্মদিন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? চার্নক কি আদৌ কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা?

২৪ আগস্ট ১৬৯০ তারিখে জোব চার্নক যে প্রথম কলকাতায় এলেন, তাও নয়। এটি তাঁর তৃতীয়বার আগমন।

এই কথা প্রথম উড়িয়ে দিয়েছিলেন রাধারমণ মিত্র। ১৯৯১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘কলকাতা বিচিত্রা’। সে-বইয়ে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন, ২৪ আগস্ট ১৬৯০ তারিখটি কলকাতার জন্মদিন নয়, আর জোব চার্নকও কলকাতার জন্মদাতা নন। এই যুক্তির সপক্ষে তিনি বিভিন্ন উদাহরণও দেন –

আরও পড়ুন
দেশের প্রথম ফটোগ্রাফিক স্টুডিও কলকাতাতেই; ১৫৩ বছরের যাত্রায় দাঁড়ি টেনেছিল অর্থাভাব

  • ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসাবিজয় কাব্যে ‘কলিকাতা’র উল্লেখ আছে – ‘পূর্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা/বেতোড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।’ অনেকে বিপ্রদাসের লেখায় ‘কলিকাতা’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত অর্থাৎ পরে সংযোজিত, এমন বলেছেন। রাধারমণের যুক্তি, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কোনোকিছুকেই প্রক্ষিপ্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া অন্যায়।
  • ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও রয়েছে কলকাতার উল্লেখ – ‘কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা/বেতোরেতে উত্তরিল অবসান বেলা।’ এটিকেও অনেকে প্রক্ষিপ্ত বলে দেগে দিয়েছেন।
  • ১৬৭৬-৭৭ সালে কৃষ্ণরাম দাস রচিত কালিকামঙ্গল কাব্যে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কলকাতার – ‘অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়।’

এছাড়াও আরও কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে রাধারমণ বুঝিয়ে দিয়েছেন, জোব চার্নক আসার আগেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। চার্নক এলেন এবং কলকাতার প্রতিষ্ঠা করলেন – এমন ভাবা ভুল।

রাধারমণ দেখালেন, ইংরাজদের নথিপত্রে ‘ক্যালকাটা’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৮৮ সালের ২২ জুন চার্লস আয়ার ও রজার ব্র্যাডিলের লেখা একটি চিঠিতে। এরপরেও, ১৬৯০-এর আগে একাধিক চিঠি ও রিপোর্টে এসেছে ‘ক্যালকাটা’ শব্দটি। আর, ২৪ আগস্ট ১৬৯০ তারিখে জোব চার্নক যে প্রথম কলকাতায় এলেন, তাও নয়। এটি তাঁর তৃতীয় আগমন। এর আগেও দু-বার কলকাতায় এসেছিলেন তিনি।

২০০১ সালের ১ আগস্ট সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থবিরোধী একটি মামলা দাখিল করে

২০০১ সালের ১ আগস্ট সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থবিরোধী একটি মামলা দাখিল করে। সেই মামলায় বাদী পক্ষে ছিলেন রাধারমণ মিত্র-সহ ন’জন নাগরিক এবং সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদের তিনজন। প্রতিবাদী পক্ষে – ১। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, ২। কলকাতা পুরসভা, ৩। কলকাতা পুরসভার মহানাগরিক, ৪। কলকাতা পুরসভার কমিশনার, ৫। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষাবিভাগের সচিব এবং ৬। ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারবিভাগের সচিব। বাদীপক্ষের হয়ে সওয়াল করেছিলেন স্মরজিৎ রায়চৌধুরী ও অজিত পাঁজা। প্রতিবাদী পক্ষের হয়ে সওয়ালে ছিলেন অ্যাডভোকেট বলাই রায়।

কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতির আদেশবলে, ২০০২ সালে তৈরি করা হয় পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। পাঁচজন সদস্যই ছিলেন স্বনামধন্য ঐতিহাসিক – নিমাইসাধন বসু, বরুণ দে, অরুণ কুমার দাশগুপ্ত, সুশীল চৌধুরী ও প্রদীপ সিংহ।

আরও পড়ুন
মৃতদেহের ছবি তোলা দিয়ে শুরু; শতাব্দী পেরিয়েও অমলিন উত্তর কলকাতার ‘সি ব্রস’ স্টুডিও

কমিটির কাছে জানতে চাওয়া হয় -
১। কলকাতার জন্মতারিখ কি ২৪ আগস্ট ১৬৯০, না অন্য কোনো তারিখ?
২। জোব চার্নক কি কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা? তিনি না হলে প্রতিষ্ঠাতা কে?
অনুসন্ধানের পর, কমিটির সদস্যরা রিপোর্ট তৈরি করে ২০০২-এর নভেম্বরে হাইকোর্টে পেশ করেন।

রিপোর্টটিতে বলা হয় – কলকাতার নির্দিষ্ট কোনো জন্মতারিখ নেই। ২৪ আগস্ট ১৬৯০ তারিখের অনেক আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। এবং, কলকাতার নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠাতাও নেই। জোব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন। 

১৬ মে ২০০৩ তারিখে, অ্যাভোকেট বলাই রায় হাইকোর্টে জানান, রাজ্য সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টটিকে মেনে নিয়েছে। তখন বিচারপতি অশোক কুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেন যে, এরপর থেকে চার্নক-কে আর কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বলা যাবে না। পাশাপাশি, কলকাতার কোনো জন্মদিন আছে – গ্রাহ্য হবে না এটাও।

রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে এরপর কলকাতার জন্ম-তারিখ ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জোব চার্নকের নাম পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য নথি থেকে মুছে দেয়। ইতিহাস বইয়েও এ-জাতীয় কোনো লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

আরও পড়ুন
২৪০ বছর আগে, আজকের দিনেই কলকাতায় ডুয়েল লড়েছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুই সাহেব

পরদিন, ১৬ মে আনন্দবাজার পত্রিকার হেডলাইন ছিল – ‘জন্মদিন নেই কলকাতার, জনকও নন জোব চার্নক’।

এ তো গেল আইনি ঘোষণা। কিন্তু বাঙালির মন থেকে কি কলকাতার জন্মদিনের তারিখটি মুছেছে? অন্যান্য নথি থেকে? এখনও কলকাতার জন্মদিন লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করলে উঠে আসে ২৪ আগস্ট, ১৬৯০ তারিখটিই। নিছক ইংরেজদের গেঁথে দেওয়া ধারণার অভ্যাস, নাকি নির্দিষ্ট একটি শুরু না পেলে খেই হারিয়ে ফেলি আমরা? এ-কথা অনস্বীকার্য, চার্নক আসার পর থেকে নগর কলকাতা রূপ পেতে শুরু করে ধীরে ধীরে। কিন্তু কলকাতার জনক নন তিনি। তাঁর আগেও ছিল এর অস্তিত্ব। কলোনিয়াল হ্যাংওভার? হয়তো বা!

ঋণ - কলকাতা বিচিত্রা (রাধারমণ রায়)

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রয়াত জাদুকর প্রিন্স শীলের স্মৃতিতে বৃক্ষরোপণ, ‘ব্যতিক্রমী’ স্বাধীনতা দিবসের সাক্ষী রইল কলকাতা