প্যাকম-প্যাকমী, নামটা শুনলেই কেমন ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা মনে পড়ে। কিন্তু আসলে এই দুই দেবদেবী এসেছেন দূর চিন দেশ থেকে। আস্তানা গেড়েছেন কলকাতার উপকণ্ঠে বজবজের সাড়ে ৬ মাইল দক্ষিণে আছিপুরে। স্থানীয় মানুষজন তাদের ডাকে খোদা ও খুদি। আবার অনেকে বলেন, তাঁদের প্রকৃত নাম নাকি থুটি কুং আর থুটি ফো। মন্দিরের অদূরেই আছে এক সমাধি। টং অছির সমাধি। তবে তাঁর আসল নাম ইয়াং দাইজাং। কিন্তু ইংরেজদের সাহেবি উচ্চারণে চিনা শব্দই হয়ে যায় 'টং অছি'। যাঁর নামে এলাকার নাম আছিপুর। কলকাতার অদূরে চিনাদের এক ব্যর্থ ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টার স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে আছিপুর। তবু 'আছি আছি' বলেও নেই কিছুই। আছু সাহেবের কারখানা নেই, জমিবাড়ি নেই। এমনকি তাঁর সমাধিও নাকি নিয়ে গেছে গঙ্গা। আজকে গেলে যে অশ্বক্ষুরাকৃতি লাল রঙের সমাধিটা দেখা যাবে, সেটা পরে তৈরি হয়েছে।
তবু নেই নেই করে থেকে গিয়েছে ইতিহাস। আজকের চায়না টাউন, টেরিটি বাজার বা জি হিং চার্চকে ঘিরে কলকাতায় যে চিনা বসতি গড়ে উঠেছে, তার যাত্রাপথ শুরু এই আছিপুরেই। সে আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। বজবজের দক্ষিণে নদী তিরে এসে ভিড়ল একটি চিনা জাহাজ। উদ্দেশ্য ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য করা। আফিমের ব্যবসাতেও ততদিনে বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাই চিন থেকে এমন জাহাজ মাঝেমাঝেই আসে কলকাতার বন্দরে। কিন্তু জাহাজ থেকে যাঁরা নামেন, তাঁরা সকলেই ফিরে যান না। তেমনই ফিরে গেলেন না টং অছি। কলকাতার অদূরে খানিকটা পরিত্যক্ত ফসলি জমি দেখে থেকে গেলেন। শুরু হল ভারতে চিনা উপনিবেশ তৈরির একটি প্রস্তুতি। তখন ১৭৭৮ সাল।
টাকা পয়সা সঙ্গে করে খুব কম আনেননি অছি সাহেব। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস অবশ্য ৫৬০ বিঘা ফসলি জমি অছিকে দানই করেছিলেন। কিন্তু সেখানে চাষাবাদের প্রস্তুতি করলেন তিনি নিজেই। আর এই সংবাদ শুনে ছুটে এলেন বর্ধমানের মহারাজা। দাবি, এই জমি তাঁর। অবশেষে কোম্পানির মধ্যস্থতায় ঠিক হল বার্ষিক খাজনার ভিত্তিতে জায়গাটির মালিকানা পাবেন আছু সাহেব। সাহেব তাতেই রাজি। কারণ তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, এখানেই তৈরি করবেন চিনির কল। আর রোজগার তাহলে নেহাৎ মন্দ হবে না।
অছি সাহেবের এই জমিকে নিয়ে আছে আরেক কিংবদন্তি। যে কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে কলকাতার চিনা সংস্কৃতিও। অনেকে বলেন, অছি সাহেবের সমাধির মতো তাঁর এলাকাও নাকি ছিল অশ্বক্ষুরাকৃতি। বড়লাট যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতটা জায়গা লাগবে; তখন সাহেব হাতের ইশারায় দেখিয়েছিলেন 'এই এত্তটা'। আর সেই ইশারা অনুযায়ী জমির আকৃতিও হয় ঘোড়ার ক্ষুরের মতো। সাহেবের সমাধির আকারও তাই। এমনকি পরবর্তীকালে কলকাতার অনেক চিনা অধিবাসীর সমাধির গঠন ছিল ঘোড়ার ক্ষুরের মতো।
আরও পড়ুন
পদে-পদে নির্ভরশীলতা, চিনা দ্রব্য বয়কট কি আদৌ সম্ভব ভারতের পক্ষে?
তবে শুরুটা বেশ জাঁকিয়ে বসলেও, বেশিদিন ব্যবসা চালাতে পারলেন না অছি সাহেব। চিন থেকে আগত অন্যান্য ব্যবসায়ীরাই নিজেদের ঈর্ষার বশে সাহেবের পিছনে লাগলেন। তাঁরা তো আর জানতেন না, সাহেব আসলে ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকাতার মতোই আরেক শহর তৈরির চেষ্টা করছেন। যে শহর আসলে চিনাদের তৈরি। স্বজাতিদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে অছি সাহেব শেষ পর্যন্ত কোম্পানির হস্তক্ষেপ দাবি করলেন। ১৭৮১ সালে কোম্পানি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করল, তারা এই চিনা উপনগরীটিকে উৎসাহ দিতে চায়। ফলত যাঁরা অছি সাহেবের চিনির কলে বাধা সৃষ্টি করবেন, তাঁরা শাস্তি পাবেন। তার প্রত্যুত্তোরে কোম্পানিকে ধন্যবাদ দিয়ে চিঠিও লিখলেন টং অছি। তবে ততদিনে অনেক শ্রমিকই তাঁর কারখানা ছেড়ে চলে গেছেন কলকাতা শহরে। ধর্মতলার কাছেই একটি জায়গায় হাত লাগিয়েছেন নতুন ব্যবসায়। সে জায়গার নাম তখন কাসাইতলা। এর কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন টং অছি। তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হল। পরে নিলামেও উঠেছিল। শুধু বিরাট জমির মধ্যে থেকে গেল টং সাহেবের তৈরি মন্দির আর তাঁর সমাধি।
আরও পড়ুন
গালওয়ান নদীর গতিপথ পাল্টাতে চাইছে লাল ফৌজ? চিনা বাহিনীর কর্মকাণ্ডে চাঞ্চল্য
এরপর কাসাইতলা থেকে সরতে সরতে চিনারা উঠেছে মধ্য কলকাতার টেরিটি বাজারে। পরবর্তীকালে কলকাতা শহরের বুকেই তৈরি হয়েছে চিনাদের নিজস্ব পাড়াও। আজও চিনা জুতো ছাড়া মন ভরে না অনেক বাঙালির। কাঠের কাজ বা কাঁচ শিল্পেও কাজ করেন অসংখ্য চিনা শ্রমিক। সবাই যেন কলকাতা শহরে কোনোভাবে একটা আশ্রয় খুঁজছেন। একটা স্বপ্নকে সত্যি করে তোলার সুযোগ খুঁজছেন। যে স্বপ্নটা হয়তো এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন অছি সাহেব। বাঙালির সংস্কৃতির মধ্যেই একখণ্ড চিনা শহর তৈরি করার স্বপ্ন। অবশ্য চায়না টাউনে গেলে সেই স্বপ্ন পুরোপুরি ব্যর্থ, একথা বলা চলে না। কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁরা যতটা মিশে যেতে পেরেছেন, বাঙালি তাঁদেরকে ততটা আপন করেনি। এক শহরে থেকেও পৃথক করে রেখেছে একটা এলাকাকে।
আরও পড়ুন
দেশজুড়ে যুদ্ধ-পরিস্থিতি, কেমন আছেন ভারতের চিনা মানুষরা?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
গন্ধ থেকেই ছড়ায় মহামারী, চিনা তান্ত্রিকদের তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পেল ইউরোপেও