ঠাকুর দালান থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা (Devi Jagaddhatri)। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ। এবার দেবীকে বরণ করে নেবেন সধবারা। কিন্তু সত্যিই কি নারী এঁরা? কারোর ঘোমটার মধ্যে দিয়েই উঁকি দিচ্ছে মোটা ফ্রেমের গ্র্যান্ড-ফাদার গ্লাস, কারোর আবার যত্ন করে রাখা প্রজাপতি গোঁফ কিংবা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। এ এক আশ্চর্য দৃশ্যই বটে।
কী ভাবছেন? বর্ণনা শুনে চন্দননগরের নামটাই নিশ্চয়ই ভেসে উঠেছে চোখের সামনে? আসলে আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে প্রকাণ্ড প্রতিমা— কলকাতার খ্যাতনামা দুর্গাপুজোকেও রীতিমতো হার মানায় চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর বাহার। তবে যে-পুজোর কথা হচ্ছে, সেটা চন্দননগর নয়, বরং তারই পাশের পাড়া ভদ্রেশ্বরের (Bhadreswar)। হাওড়াগামী ট্রেনে প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ ছাড়িয়ে আর দুটো স্টেশন ছেড়েই ভদ্রেশ্বর। তারপর রেল স্টেশন থেকে মিনিট বিশেকের হাঁটা পথ। তাহলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে তেঁতুলতলার এই আশ্চর্য পুজোয়।
হ্যাঁ, তেঁতুলতলায় দশমীর দিন নারীরা নয়, বরং পুরুষরাই বরণ করে নেন ‘বুড়ি মা’-খ্যাত দেবী-প্রতিমাকে। পরনে পাট ভাঙা শাড়ি, মাথায় সিঁদুরের টিপ, হাতে শাঁখা-পলা— বছরের একটা দিন নারীর সাজেই সেজে ওঠেন তেঁতুলতলার পুরুষরা। এ-হেন উদাহরণ বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতে দ্বিতীয় কোথাও নেই বললেই চলে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এ-হেন আশ্চর্য রীতির কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। সেই গন্ধের টানেই ফিরতে হবে অষ্টাদশ শতকে। জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রাণপুরুষ হিসাবে ধরে নেওয়া যায় কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে। খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায়, দুর্গাভক্ত কৃষ্ণচন্দ্রকে আটক করেছিলেন নবাব আলিবর্দী খান। কৃষ্ণচন্দ্র যখন নিজরাজ্যে ফিরলেন, তখন শরৎ পেরিয়ে বাংলার বুকে ধীরে ধীরে পশরা সাজাচ্ছে শীত। কিন্তু দেবী আরাধনা কি তবে থেমে থাকবে? প্রচলিত অকালবোধনের রীতি ভেঙে তাই আরেক অকালবোধনের দিকেই তাই পা বাড়ান মহারাজ। কার্তিকের শুক্লানবমীদের জগদ্ধাত্রী রূপে পুজো করেন দেবী দুর্গার।
তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর হাত ধরেই শুরু হয় তেঁতুলতলার এই পুজো। সেটা প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। অবশ্য তখনও পর্যন্ত এই পুজো ছিল বাড়ির পুজো। তবে তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে পুজোর জমক। ইন্দ্রনারায়ণের দুই কন্যাই বিধবা হওয়ায়, নিভে যায় পারিবারিক আয়ের সলতেও। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ। সবমিলিয়ে আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হতে বসে এই পুজো। সে-সময় এগিয়ে এসেছিলেন গ্রামের মানুষরাই। পারিবারিক পুজো থেকে বারোয়ারি হয়ে ওঠেন তেঁতুলতলার জগদ্ধাত্রী। তারপর পেরিয়ে গেছে ২২৯টা বছর।
তবে বারোয়ারি পুজো হলেও, এই পুজোয় সে-সময় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারতেন না স্থানীয় মহিলারা। না, পুরুষতান্ত্রিক কোনো রেওয়াজ লুকিয়ে নেই এর পিছনে। বরং, এর জন্য দায়ী ঔপনিবেশিক শাসকরাই। ব্রিটিশ শাসকদের লোলুপ দৃষ্টির সামনে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না মহিলারা। সেইসঙ্গে সে-সময় লেগেই থাকত ডাকাতির ঘটনা। কিন্তু তা-বলে কি থমকে থাকবে দেবীর বরণ-প্রক্রিয়া? অর্ধাঙ্গিনীর এই দায়িত্ব তুলে নিজেদের কাঁধে তুলে নেন স্থানীয় পুরুষরা। শাঁখ-পলা-সিঁদুর-শাড়িতে সজ্জিত হতেই দেবী বরণের প্রক্রিয়ায় অংশ নেন তাঁরা। সেই থেকে নয় নয় করে কেটেছে ২২৯টা বছর। তবুও ছেদ পড়েনি এই অদ্ভুত রীতিতে।
জগদ্ধাত্রী পুজোর জনপ্রিয়তার নিরিখে চন্দননগর ও কৃষ্ণনগরের নামই উঠে আসে সবচেয়ে আগে। তবে সেই তালিকায় পিছিয়ে নেই ভদ্রেশ্বরও। আর তার অন্যতম কারণ তেঁতুলতলার এই ঐতিহাসিক জগদ্ধাত্রী পুজো। শুধু বরণ দেখতেই প্রতিবছর এই মণ্ডপে ভিড় জমান লক্ষাধিক দর্শনার্থী। জীবন্ত ইতিহাস-ঐতিহ্যকে চেখে দেখার লোভ কী সামলানো যায় এত সহজে?
Powered by Froala Editor