১৫০ জনের মৃত্যু, ২ লক্ষ বাস্তুহারা - আয়লার ভয়ঙ্কর স্মৃতির মধ্যেই আসছে আমফান

অভ্যাসমতো আবারও মাঠে নেমেছেন সুন্দরবনের কৃষকরা। হাল টানার জন্য গবাদি পশু নেই, তাই দেহাতি পুরুষরা নিজেরাই কাঁধে জোয়াল তুলে নিয়েছেন। প্রতি বছরের মতো কি এবারও হতাশ করবে ফসলের দেবতা? এভাবেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন তাঁরা। এগারো বছর আগের সেই বিধ্বংসী ঝড়ের স্মৃতি আজও জীবন্ত। এতগুলো বছর পরেও, স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারল না সুন্দরবনের জীবন ।

চোখ বন্ধ করলেই আজও মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। ২৫ মে, ২০০৯। ঘড়ির কাঁটা তখন সবে বেলা এগারোটা পেরিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রত্যেকেই জেনে গিয়েছেন ঝড়ের নাম 'আয়লা'। অবশ্য সমুদ্রের কাছেই যাঁদের বাস, ঝড় তো তাঁদের কাছে নতুন কিছু নয়। সরকার এবং আবহাওয়া দপ্তর বারবার বলেছে, এই ঝড় একেবারেই আলাদা। স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে বারবার মাইকে ঘোষণা করা হয়েছে সেই সতর্কতার কথা। কিন্তু উপকূলে ঝড় আছড়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তার ভয়াবহতা বুঝতে পারেননি সাধারণ মানুষ।

দেখতে দেখতে নদীর জল ফুলে উঠতে শুরু করল। মানুষ তার চোখের দেখাতেই বুঝেছিল, এই জলস্তরের উচ্চতা ৫০ মিটারের কম নয়। আর সেইসঙ্গে প্রচণ্ড বেগে হওয়া দিতে শুরু করে। পরে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। সমুদ্রের ঝড়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় থাকলেও, এমন ভয়ঙ্কর ঝড়ের কথা মনে করতে পারেননি সুন্দরবনের মানুষ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সবকিছুই লণ্ডভণ্ড করে ক্রমশ উত্তর-পূর্বে সরে যায় ঘূর্ণিঝড় আয়লা। আর তার আগেই অন্তত ১১৫ জন মানুষের এবং অসংখ্য গবাদি পশুর প্রাণ নিয়ে গিয়েছে। আর যাঁরা বেঁচে গেলেন? পরবর্তী প্রতিটা দিন কাটাতে হয়েছে ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে। পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলের অন্তত ২ লক্ষ মানুষ আয়লার প্রকোপে পড়েছিলেন। আর ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫ লক্ষের কম নয়।

আয়লার প্রভাব যে শুধু সমুদ্র উপকূলেই পড়েছিল, এমন নয়। দুই চব্বিশ পরগনা এবং দুই মেদিনীপুরের উপরেই অবশ্য সতর্কতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে কলকাতা, হাওড়া, এমনকি বাঁকুড়া জেলাতেও আয়লার প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছেন মানুষ। আর একটানা তিনদিন ধরে প্রবল বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়ায় অস্থির হয়ে উঠেছিল হুগলি, নদীয়া, বর্ধমানসহ দক্ষিণবঙ্গের প্রতিটি জেলা। তবে ঝড়ের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তী, গোসাবা এবং সন্দেশখালি ব্লক। আর সেইসঙ্গে বাংলাদেশের খুলনা জেলার কয়রা এবং দাপোক অঞ্চল।

আজ ১১ বছর পরেও দাপোকের ২৫০টি পরিবার রাস্তার ধারে ছাউনি বানিয়ে বাস করতে বাধ্য হন। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও তথৈবচ। সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও উপযুক্ত পুনার্বসন পাননি অনেকেই। আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৬৭ কিলোমিটার নদীবাঁধ পুনঃনির্মাণের কাজ শেষ হয়নি এখনও। আর মাটিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বহু প্রজন্মের কৃষিকাজের জীবিকা থেকেও সরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। কাজের সন্ধানে আজও বহু মানুষ পারি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে। আর যাঁরা এখনও মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন, মাটিতে তাঁদের ব্যর্থ চেষ্টার আঁচড় পড়ছে প্রতি বছর।

১১ বছর পরেও সেই বিভীষিকার কথা স্পষ্ট মনে পড়ে সুন্দরবনের মানুষের। আর তার মধ্যেই আসতে চলেছে আরও এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড় নাকি আয়লার থেকেও ভয়ঙ্কর। বাতাসের গতিবেগ নাকি ঘণ্টায় আরও অনেকটাই বেশি হতে পারে। ভারতবর্ষের উপকূলে এই শতাব্দীর প্রথম সুপার সাইক্লোন আমফান। আর একদিনের মধ্যেই তা সুন্দরবনের বুকে আছড়ে পড়তে চলেছে বলে জানাচ্ছেন মেটিরিওলোজিস্টরা। আয়লার জীবন্ত স্মৃতির মাঝে সেই ভয়ঙ্কর সময়ের প্রতীক্ষা করছেন মানুষ। এমনিতেই করোনা মহামারীর কারণে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। তার উপর আরেক আক্রমণ শানাচ্ছে প্রকৃতি। এই অসম লড়াইতে কি টিকে থাকতে পারবেন সুন্দরবনের মানুষ? এই চিন্তাই এখন সকলের মনের মধ্যে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

More From Author See More